জয় শ্রীরাম ধ্বনিটা ধর্মান্ধদের মুখে হয়ে উঠেছে লাগামছাড়া হিংসার আওয়াজ। আদবানির রামরথের আমল থেকে শুরু করে ঝাড়খণ্ডে তবরেজ আনসারিকে খুন করা পর্যন্ত একই ঘটনা বারবার ঘটতে দেখছি আমরা। জয় শ্রীরাম ধ্বনিটা নিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর আপত্তির কারণটা আরেকবার স্পষ্ট হল। মোটর সাইকেল চোর সন্দেহে যাকে পিটিয়ে মারা হল তার একটাই অপরাধ তিনি মুসলমান। শুধু আজকে নয় বিজেপি�র সুশাসনের প্রমাণ দিতে এঘটনা ঝাড়খণ্ডে বারবার ঘটছে। ২০১৬ সালে এই রাজ্যের লাটেহারে স্রেফ গরু কেনাবেচার অপরাধে দুজন মুসলমান ব্যবসায়ীকে পিটিয়ে মেরেছিল গোরক্ষকরা। ২০১৮ সালে গরু চুরির অপরাধে আরও দুজনকে পিটিয়ে মারা হয়। বর্বরতা এবার আরও লাগামছাড়া। ২০১৯ সালে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্রে একটি ২৪ বছরের যুবককে পিটিয়ে মারার সময় তাকে আর্ত চিৎকারের বদলে রাম নাম করতে বাধ্য করা হল। গত তিন বছরে ঝাড়খণ্ডে ধর্মান্ধদের গণপ্রহারে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ালো ১৩ জন।
অথচ কিছুদিন আগে ক্ষমতায় আসার পর লালকেল্লায় ভাষণ দেওয়ার সময় মোদি বলেছিলেন, সব কা সাথ, সব কা বিকাশ, সব কা বিশ্বাস। কথাটা যে কত বড় মিথ্যা তা তবরেজকে পিটিয়ে খুনের ঘটনাটা প্রমাণ করে দিচ্ছে। মোদি ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের আচরণে প্রমাণ হচ্ছে তারা দেশটাকে শুধুই হিন্দুদের দেশ হিসেবে দেখতে চান। যেখানে পরিকল্পিত হিংসায় মুসলমানদের খুন হওয়াটাই যেন একটা স্বাভাবিক ব্যাপার। এদেশের ১৭ কোটি মুসলমানদের অস্তিত্ব বিজেপি স্বীকার করেনা। রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের ধর্মীয় সহিষ্ণুতার ভাবনার ছিটেফোঁটাও তাদের মধ্যে নেই।
ঠিক একারণেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় জয় শ্রীরাম ধ্বনিটার বিরুদ্ধে বারবার সরব হয়েছেন। আমার মতে উত্তেজনা এড়াতে রাস্তাঘাট, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র �জয় শ্রীরাম� ও �আল্লা হো আকবর� ধ্বনি দেওয়া নিষিদ্ধ করা হোক। কারণ কোন ভক্তি নয়, কোন বিশ্বাস নয় দাঙ্গাবাজরা একটা ধর্মীয় উন্মাদনা তৈরি করতেই এদুটি ধ্বনিকে ব্যবহার করে। যে সব বুদ্ধিজীবীরা জয় শ্রীরাম ধ্বনি নিষিদ্ধ করার প্রতিবাদে সামিল হয়েছেন, তারা বুঝছেন না, ধর্মান্ধরা এই ধ্বনিকে সাম্প্রদায়িকতার হাতিয়ারে পরিণত করেছে।
আমি গুজরাটের দাঙ্গা, রামরথ চলাকালীন হাঙ্গামা, অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বলতে পারি ধর্মান্ধদের জয় শ্রীরাম আদতে একটা বিদ্বেষ সৃষ্টিকারী ধ্বনি। মুখ্যমন্ত্রীর কনভয়ের পাশে জয় শ্রীরাম ধ্বনির সব ঘটনারই আমি প্রতক্ষ্যদর্শী। আমি দায়িত্ব নিয়ে বলছি কোন ভক্তি নয়, প্রতিবারই কিছু সমাজবিরোধী বাংলার মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যঙ্গ করার জন্যই জয় শ্রীরাম ধ্বনি তুলেছিল।� যারা হত্যার মত একটা নৃশংস ঘটনার সঙ্গে ধর্মীয় আওয়াজ জুড়ে দেন তারা আর যাই হোক কোন ধর্মেই বিশ্বাসী নন। তাদের একটাই ধর্ম, তা হল হিংসা। এই হিংস্র রাজনীতিকে এখনই না ঠেকাতে পারলে দেশে কোন বিরোধী রাজনীতির অস্তিত্ব থাকবে না।
ছোটবেলায় রাতে অবাঙালি শবযাত্রীদের �রাম নাম সত্ হ্যায়� আওয়াজ জানলা পেরিয়ে কানে ধাক্কা দিত। বাঙালিরা শবযাত্রীরা বলেন, �বল হরি হরিবোল�। আর ধর্মান্ধ ঘাতকরা একটা তরতাজা ছেলেকে দিনভর পেটানোর সময় কান্না আর আর্ত চিৎকারের বদলে জোর করে সেই রামের নামই বলাতে বলাতে মৃত্যুর রাস্তা দেখিয়ে দিল। মোদি অ্যান্ড কোং এর বোধবুদ্ধির গঙ্গাযাত্রা অনেকদিন আগেই ঘটে গেছে। ধর্মান্ধতার বিরুদ্ধে এখনই প্রতিবাদ গড়ে তুলতে না পারলে আমাদের বোধবুদ্ধিরও গঙ্গাযাত্রা ঘটে যাবে।
আমরা প্রতিনিয়ত শুনছি – মেরা ভারত মহান। অন্য ধর্মের মানুষদের বিরুদ্ধে চুরির অভিযোগ তুলে তাদের একের পর এক পিটিয়ে খুন করা কি এই মহত্বের নমুনা? তা না হলে আমরা ধর্মান্ধ ও দাঙ্গাবাজদের এই লাগাতার অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সরব হচ্ছি না কেন? খবরের কাগজে, টিভিতে, সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা কাটমানি নিয়ে গলা ফাটাচ্ছেন তারা এই খুনের ঘটনায় এখনও কেন নীরব? এরপরেও কি আমরা বলতে পারবো � মেরা ভারত মহান?
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত