কোন প্রতিষ্ঠান বা সংস্থার স্বীকৃতি পাওয়ার বহু আগেই কলকাতা সাহিত্যের শহর। তবুও আমার শহর ইউনেস্কোর �সিটি অফ লিটারেচার� সন্মান পেতে পারে এই খবরে আমার খুব আনন্দ হচ্ছে। আমার আনন্দ হচ্ছে বলে আপনারা কেউ ভেবে বসবেন না আমি একজন সাহিত্যরসিক বা সংস্কৃতিপ্রেমী মানুষ। তবে নিজে �অশিক্ষিত হলেও লোকে বই পড়ছে, বই নিয়ে আলোচনা করছে কিংবা বই কেনার জন্য কাউন্টারে হামলে পড়ছে এমন দৃশ্য দেখলে আমার ভেতর থেকে খুব আনন্দ হয়। ভাল লাগে সাহিত্য নিয়ে কাউকে কোন আলোচনা করতে দেখলে।
গ্রামের ছেলে আমি, ছোটবেলায় গল্পের বইটই পড়ার খুব একটা সুযোগ পাইনি। তবুও টুকটাক বইপত্তর পড়তাম। একটা জিনিস আমার মনে হত, আমরা সবাই যে জিনিসটা দেখছি সেই চেনা জিনিসটাই লেখকরা কেমন অন্যভাবে দেখছেন! এ বড় সহজ কথা নয়। পেশার সুবাদে খবরের কাগজে ঢুকে পড়ার পর দেখলাম, বইয়ের মলাটে নাম আর ছবি দেখা মানুষগুলো আমার চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। কাজ করছেন, হাসছেন আবার কখনও কখনও ব্যাপক রেগেও যাচ্ছেন। আমার সঙ্গেই লিফটে উঠছেন সুনীলদা, নামছেন শীর্ষেন্দুদা, অফিসে ঢোকার মুখে কখনও বা দেখছি গেটের একপাশে ফুটপাথের ওপর দাঁড়িয়ে সিগারেট খেতে খেতে আড্ডা দিচ্ছেন রমাপদদা আর নীরেনদা। আরও অবাক হলাম এরা সবাই আমার সঙ্গে হেসে কথাও বলছেন, লেখক বলে কোন গম্ভীর ব্যাপার নেই। শুধু অফিস নয়, আমাদের এই শহরটার প্রতিটি কোণে এই ঘটনা ঘটে চলে।
আমার মনে পড়ছে শক্তিদার কথা। আনন্দবাজারে কাজ করার সময় দেখতাম, যখন লোকের আনাগোনা কম, সকালের দিকে ঠিক সেই সময় শক্তিদা অফিসে চলে আসতেন। মুখোমুখি হলেই তিনি অশোক এদিকে এসো বলে ডেকে নিতেন আড্ডায়। অফিস জমজমাট হয়ে উঠলেই শক্তিদা উধাও। বলতেন, আমার অফিস হয়ে গেছে। তাঁর সঙ্গে খালাসিটোলায় বাংলা খেতে খেতে আড্ডা আমার জীবনে এক বড় উপার্জন। আজকালে থাকাকালীন শ্যামলদা আর সন্দীপনদার সঙ্গে আড্ডাও এক অনন্য অভিজ্ঞতা। আমি জানিনা, পৃথিবীর আর কোন শহরে আমার মত একজন সাধারণ মানুষের এত বড় মাপের লেখক, কবিদের সান্নিধ্যলাভের সুযোগ হয়? ����
এই শহরে যারা সাহিত্য খুব একটা পড়েন না তারাও সাহিত্য, লেখক এমনকি পড়ুয়াদেরও খুব মর্যাদা দেন। মানুষ যখন নিজেদের বেঁচে থাকা নিয়েই খুব ব্যস্ত তখন বইও যে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারে তা দেখতে হলে কলকাতায় আসতেই হবে। কলকাতায় আসার পর কলেজে পড়ার সময়ে দীপক মজুমদার, অরূপরতন বসু, রাঘব বন্দ্যোপাধ্যায়দের মত অন্যধারার লেখক, কবিদের সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আশ্চর্য মানুষ ছিলেন এঁরা। বই, লেখালেখি মিশেছিল এদের জীবনযাপনে। কত তরুণের জীবন যে এদের সংস্পর্শে এসে বদলে গেছে, তারা সাহিত্যকে ভালবাসতে শিখেছে তা আমি চোখের সামনে দেখেছি। সাহিত্য যেন এ শহরের অস্থিমজ্জায় জড়িয়ে আছে। তাই কলকাতা সাহিত্যের শহরের তকমা পেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই। বরং না পেলেই মনে হবে শহরকে তার মর্যাদা থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে।
ছবি তোলা আমার পেশা। নানাধরণের মানুষদের সংস্পর্শে আসতে হয় আমাকে। আমি দেখেছি রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে হিসেব রক্ষক, বইয়ের বাতিক প্রায় সকলের। হাম ও হুপিংকাশির মত এই শহরে একটা বয়সে প্রায় সব তরুণকে আক্রমণ করে কবিতা ও লেখালেখির ঝোঁক। আরও আশ্চর্য ব্যাপার হল সেসব পড়ার, তা নিয়ে আলোচনা করার এমনকি ছাপানোর লোকও জুটে যায়। অনেক নিন্দুক লোক কলকাতার সাহিত্যপ্রীতি নিয়ে মুখ বেঁকাতে পারেন, কিন্তু সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা না থাকলে এটা হয়না। এই সমঝদারী দেশের আর কোন শহরে নেই। সাহিত্যের শহর কলকাতা হবেনা তো আর কে হবে?
জন্ম ও কর্মের সুবাদে এই শহরের সঙ্গে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, বঙ্কিমচন্দ্র, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর, জীবনানন্দ দাশ, বুদ্ধদেব বসু, আশাপূর্ণাদেবী, মহাশ্বেতাদেবী� সহ বহু লেখক, কবির যোগাযোগ। সবার নাম বলার মত পান্ডিত্য আমার নেই, তাই অনেকেই বাদ পড়লেন। অসংখ্য লেখক, কবির সৃষ্টি ও অনুভবে ধন্য হয়েছে এই শহর। সাহিত্যের শহর হিসেবে কলকাতার স্বীকৃতি আদতে এদেরই স্বীকৃতি।
আমাদের রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি অনুরাগের কথা সবাই জানেন। নিজের মত করেই কবিতা, গান লেখেন তিনি, আঁকেন ছবিও। সেগুলির মান নিয়ে কিছু বলার দুঃসাহস আমার নেই। তার জন্য শিল্পসাহিত্যের বোদ্ধা ও সমালোচকরা আছেন। কিন্তু এত ব্যস্ততার মধ্যেও এসবের জন্য যে তিনি সময় দিচ্ছেন এটাই আমার ভাল লাগে। সাহিত্য সংস্কৃতির প্রতি এই আগ্রহটাই সবচেয়ে বড় কথা। শুধু মুখ্যমন্ত্রী নন, আইনজীবী, খেলোয়াড়, তথ্যপ্রযুক্তি কর্মী, সরকারি কর্মী, ব্যাঙ্ক কর্মচারী সহ নানা পেশার মানুষদের সাহিত্যের প্রতি ভালবাসা কেউ ঘোষণা করার আগেই কলকাতাকে সাহিত্যের শহর করে দিয়েছে।
সাহিত্যের সঙ্গে শহরের যোগ তো আর আজকের নয়, বাংলা মুদ্রণ শিল্প ও হরফের জন্মের সঙ্গে জড়িয়ে আছে এই শহর। কলকাতার চিৎপুর এলাকায় ছিল দেশের সবচেয়ে পুরনো বইবাজার। বটতলার বই এবং কাঠখোদাই ছবি এখন বিদেশী মিউজিয়ামে ঠাই পেয়েছে। এই শহরেই হয় জনসমাগম ও আয়তনের বিচারে সবচেয়ে বড় বইমেলা। দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী কলকাতা সাহিত্যের শহর হিসেবে স্বীকৃতি পেলে তার গৌরবের মুকুটে যুক্ত হবে একটা নতুন পালক।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত