রাজ্যের স্বাস্থ্য পরিষেবাকে অচল করে দিয়ে কর্মবিরতিরত ডাক্তাররা আওয়াজ তুলেছেন – উই ওয়ান্ট জাস্টিস। সকালবেলা এসএসকেএম চত্বরে ঘুরতে ঘুরতে আমার মনে হল, জাস্টিস চাওয়াটা কি শুধুই ডাক্তারদের অধিকার? দূরদূরান্ত থেকে হাসপাতালে আসা মুমুর্ষ রোগীরা মলিন মুখে বসে আছেন। চিকিৎসা চাইতে চাইতে ক্লান্ত বাবার কোলে নেতিয়ে পড়েছে দুধের ছেলে, হাসপাতালের করিডরে শুয়ে পড়েছেন অসুস্থ রোগী। অসুস্থ শিশুকে বুকে জড়িয়ে ধরে হাসপাতালের বিভিন্ন ওয়ার্ডে ঘুরে বেড়াচ্ছেন মা। এরাও তো বলতে পারেন – উই ওয়ান্ট জাস্টিস। পরিবহ মুখোপাধ্যায়ের ওপর হামলা নিশ্চয়ই নিন্দনীয়। কিন্তু তার বদলায় হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের চিকিৎসা থেকে বঞ্চিত করাটা কী নিন্দনীয় নয়?
চিকিৎসকদের ওপর একশ্রেণীর সমাজবিরোধীদের হামলার বদলা নিতে গিয়ে চিকিৎসাশাস্ত্রের এথিকসটাই ভেঙে ফেলেছেন আন্দোলনকারীরা। রোগীদের তারা ঠেলে দিচ্ছেন মৃত্যুর মুখে। এই বর্বরতা শিক্ষিত, মেধাবী এবং সমাজের প্রতি যাদের দায়বদ্ধতা প্রশ্নাতীত সেই ডাক্তারদের কাছ থেকে আশা করা যায়না। আপনাদের মত অত শিক্ষিত আমি নই, কিন্তু চিকিৎসা একটা জরুরি পরিষেবা। এর ওপর নির্ভর করে মানুষের মরণবাঁচন। এটা যখন তখন খেয়ালখুশি মত বন্ধ করে মানুষের ওপর চাপ সৃষ্টি করা যায়না। আপনাদের বদলার রাজনীতিতে প্রাণ যাচ্ছে নিরীহ রোগীদের। বুধবার রাতে এনআরএস হাসপাতালে পরিষেবা না পেয়ে বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন সোনারপুরের ৬০ বছরের প্রবীণা মঞ্জু বন্দ্যোপাধ্যায়। একই হাসপাতালে নিউরোলজ্যিকাল ওয়ার্ডে মারা গেছেন সোদপুরের বাসিন্দা কৌশিক দাস। অসংখ্য মৃত্যু মিছিল থেকে আমি শুধু দুটি ঘটনা বললাম। এদের বাড়ির লোকও বলছেন, উই ওয়ান্ট জাস্টিস।
হাসপাতালে কিছু হলেই ডাক্তারদের দাবী মুখ্যমন্ত্রীকে আসতে হবে। আচ্ছা, এই কাজটা যদি তিনি নিয়মিত করেন তাহলে প্রশাসনটা চালাবেন কে? মুখ্যমন্ত্রী প্রশাসনের সর্বোচ্চ আসনে বসে আছেন। তিনি যদি সব জায়গায় যান তাহলে প্রশাসনটা আছে কী করতে? আবার আজ সকালে যখন মুখ্যমন্ত্রী অনশন তোলার অনুরোধ করতে এসএসকেএম চত্বরে গেলেন তখন কথার বদলে আপনারা স্লোগান তুললেন, উই ওয়ান্ট জাস্টিস। হাসপাতালটা চিকিৎসার জায়গা, তা পুলিশ ব্যারাকও নয়। প্রতিটি ডাক্তারের পিছনে নিরাপত্তারক্ষী দেওয়া অসম্ভব। ডাক্তারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা বলতে আপনারা কী বলতে চাইছেন তা বোঝা গেলনা।
হাসপাতালে আসা রোগীর পরিজনরা কোন ঘটনায় মাথাগরম করে ডাক্তারদের আক্রমণ করলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। কিন্তু তার দায় অন্য রোগীদের ওপর চাপবে কেন? এর প্রতিবাদে চিকিৎসা বন্ধ করে দেওয়াটাও সমর্থনযোগ্য নয়। কারণ তখন চিকিৎসা ব্যাপারটাই কোমায় চলে যায়। রোগীর অসুখ হলে আপনারা সারান কিন্তু চিকিৎসার অসুখ হলে সারাবে কে? কিছু লোকের অপরাধের দায় রাজ্যের সব লোকের ওপর চাপানো যায়না। হাসপাতালে রোগীর সঙ্গে আসা একশ্রেণীর মানুষের হাঙ্গামা বন্ধ করতেই হবে। কিন্তু নিরাপত্তার গ্যারান্টি না পাওয়া পর্যন্ত চিকিৎসা করবো না এই যুক্তি মানা অসম্ভব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে গিয়ে পুলিশ বহু জায়গাতেই আক্রান্ত হয়। অনেক জায়গায় দমকল কর্মীরা দেরী করে পৌঁছলে আক্রান্ত হন। তখন কী তারা কর্মবিরতি আন্দোলনে নামেন?
রাজ্যের প্রতিটি মানুষ ডাক্তারদের ওপর আক্রমণের বিপক্ষে। কিন্তু আন্দোলনের নামে আপনারা যেটা করছেন তা হল পাবলিককে একটু টাইট দেওয়া যাক মার্কা বদলার রাজনীতি। আপনাদের কর্মবিরতির শুরুতেও কিন্তু জরুরি পরিষেবা বন্ধ করে দেওয়ার কথা ছিলনা। আপনারা এখন সে রাস্তায় হাঁটছেন, এটা কিন্তু মানুষ ভালোভাবে নিচ্ছেন না। প্রথমদিকে রাজ্যের সব মানুষের সমর্থন ও সহানুভূতি আপনাদের সঙ্গে ছিল। কিন্তু খোঁজ নিয়ে দেখুন হাসপাতাল চত্বরের রোগীদের দুরাবস্থা, রোগীর মৃত্যু ইত্যাদি ঘটনায় মানুষ কিন্তু বিরক্ত হতে শুরু করেছেন। এই বিরক্তি না কমলে আপনাদের নিরাপত্তা সহ কাজকর্মের নানা সুবিধা-অসুবিধা সংক্রান্ত দাবীগুলো পিছনে চলে যাবে। আপনাদের ন্যায্য দাবীগুলি বদলার রাজনীতির গলিতে দিশা হারাবে।
আমি আমার নিজের কথাই বলি, আমার মা দীর্ঘদিন ধরেই অসুস্থ। কাল যদি আমি কোন সরকারি হাসপাতালে মাকে নিয়ে যাওয়ার পর ডাক্তার না দেখাতে পেরে উত্তেজিত হয়ে কোন চিকিৎসকের দিকে তেড়ে যাই সেটা কী আমার দোষ? দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা না পেয়ে মানুষ যদি মারমুখী হয়ে চিকিৎসকের ওপর হামলা চালায় তার দায় কে নেবে? একটু ভেবে দেখবেন।���
মানুষকে স্বাস্থ্য পরিষেবা দেওয়াটাই আপনাদের কাজ। প্রশাসনের কাজ হল সেই পরিষেবা প্রদানের ব্যবস্থা করা। এটা ঘটনা পরিকাঠামোর তুলনায় আপনাদের কাজের চাপ অনেক বেশি। তার জন্য আপনাদের অনেক বেশি পরিশ্রম করতে হয়, ঝামেলাও বাড়ে। মানুষ অনেক আশা নিয়ে আপনাদের কাছে আসে। দু একটা মানুষের হিংসাত্মক হয়ে ওঠার দায় সবার ওপর চাপাবেন না। স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়াটাও কিন্তু মানুষের অধিকার। এটা না দিলে তারাও বলবে – উই ওয়ান্ট জাস্টিস।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত