ফিরে আসার কথা তো সবাই বলে। কে বলে এ বার জিতব না। নিশ্চিত হার জেনেও বলে, বিপূল গরিষ্ঠতা পাব। এটাই গণতান্ত্রিক দেশের পরিচিত কৌশল। কিন্তু ‘তিনশো পার অবকি বার’ বা ‘ফির একবার মোদী সরকার’ – এই স্লোগানে যে তেমন ধার ছিল না তা ভোটযুদ্ধের শেষ লগ্নে পৌঁছে সকলেই বুঝেছিল। আবার সংবাদপত্র বা গণমাধ্যমও নানা সমীক্ষার গল্প শোনানোর ফাঁকে ফাঁকে ভোটের ভবিষ্যত ব্যাখ্যা করেছে মাছের তেলে মাছ ভাজার মতো করে। ক্ষমতাবান নেতানেত্রীদের বেছে নিয়ে, কী বললে লিখলে তাঁরা সন্তুষ্ট হবেন বুঝে নিয়ে, তাঁদেরই নেপথ্যের উক্তিগুলোকে পথ্য করে চূড়ান্ত রায় দিয়েছে তারা।
স্বভাবতই ক্ষমতাসীন শিবিরে কাগজ, পোর্টাল, চ্যানেলের ছড়াছড়ি। হাতে গোনারা পড়ে আছে প্রতিষ্ঠান-বিরোধিতার সনাতনী সংলাপ সম্বল করে। ক্ষমতাবানদের মধ্যেও মেরু আছে। কেউ কেন্দ্রীয়, কেউ বা বিকেন্দ্রীয়। আসলে মেরুকরণে তো দু’মেরুরই লাভ। কারও বেশি, কারও কম। কিন্তু দুয়েতেই উত্তরণ। যে কারণে বিজেপির পাশাপাশি লাভ হয়েছে সপা-বসপারও। এরমধ্যে আবার অখিলেশের তেমন লাভ না হলেও মায়াবতী কিছুটা লাভের কড়ি গুনেছেন। আর অজিত সিং হতাশ হলেও, উত্তর প্রদেশের মতিগতি উদ্বেগের বিজেপির কাছেও।
বিরোধী মহাজোট নিচুতলা পর্যন্ত সে ভাবে হয়নি। রক্ত সঞ্চালন সারা শরীরে সঠিক ছিল না। তবুও দীর্ঘকালীন রাজনীতির পথিক ভাজপা মনে করছে, এবারের ফলও অশনিসংকেত। বিরোধীরা পদে পদে পদে ভুল না করলে তাদের আরও আসন কমত। ভেস্তে যেত ধর্মীয় মেরুকরণ। এই অবস্থায় বিজেপির নয়া টোটকা ভাষার মেরু বিভাজন। যা এত দিন তারা অস্বীকার করে এসেছে, সেটাই এখন তাদের হাতে ব্রহ্মাস্ত্র। যা দিয়ে উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশ্চিম দলমত নির্বিশেষে বিরোধীদের ব্যাপক ঐক্য রুখে দেওয়া যাবে। ধর্ম দিয়ে এটা সম্ভব নয়। এজন্য চাই মাতৃভাষার মেরুকরণ।
সঙ্ঘের তত্ত্ব অনুযায়ী ‘হিন্দি, হিন্দু, হিন্দুস্তান’ তূণীরের শেষ দুটি তির তুলে নেওয়া হয়েছে সদ্য হয়ে যাওয়া লোকসভা ভোটে। এবার দরকার প্রথম তির। সে জন্যই নতুন মানবসম্পদ উন্নয়ন মন্ত্রী রমেশ পোখরিয়াল নিঃশঙ্কের কাছে কস্তুরীরঙ্গন কমিটি যে রিপোর্ট পেশ করেছে তাতে স্কুলে ত্রিভাষা সূত্র চালু করার কথা আছে। অর্থাৎ অহিন্দিভাষী দক্ষিণ, পূর্ব, উত্তর পূর্ব ভারতেও হিন্দি পড়া বাধ্যতামূলক হবে। দীর্ঘদিন আগে হিন্দি নিয়ে উত্তর-দক্ষিণ সংঘাতের পরিস্থিতি অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছিল। আঞ্চলিক দলগুলোর নেতৃত্বে আন্দোলন দানা বাঁধে।
সেই থেকেই তামিলনাড়ুতে জাতীয় দল কংগ্রেসের শক্তি কমে। আর বিজেপিও সেখানে তেমন স্বনির্ভর হতে পারেনি। তেলেঙ্গানা, অন্ধ্র, এমনকি কর্ণাটকেও আঞ্চলিক দল জাতীয় দলের জমি অনেকটাই দখল করে। কেরলে একমাত্র জাতীয় দল সক্রিয়। কিন্তু হিন্দি সম্পর্কে আপত্তি পুরো মাত্রায় বহাল। প্রসঙ্গত, উত্তর-দক্ষিণের মধ্যে সেতুবন্ধনের প্রকৃত গোড়াপত্তন হয় ‘৮৯-এর রাষ্ট্রীয় মোর্চার সরকারের হাতে। কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতার শরিক হয় ডিএমকে, টিডিপি প্রমুখ। ফের ‘৯৬-এর যুক্তফ্রন্ট সরকার আরও অগ্রসর হয়। প্রধানমন্ত্রী ভিপি সিং এগিয়ে ছিলেন সর্বাগ্রে। তার পর দেবগৌড়ার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে সমর্থন করেন কংগ্রেসের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও সভাপতি পিভি নরসিংহ রাও।
পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী গুজরালের আমলে একই সরকার বহাল থাকলেও শেষটা জৈন কমিশনের রিপোর্ট বেরোনোর পর কংগ্রেসের দাবিতে ডিএমকে সরকার ছাড়ে। সরকারও পড়ে যায়। ‘৯৮-এ বাজপেয়ী সরকার চালান প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে দক্ষিণের আঞ্চলিকদের সঙ্গে। ইউপিএ মনমোহনের নেতৃত্বে ডিএমকে-কে সঙ্গে পায়। এছাড়া প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে সরকারের সঙ্গে থাকেন মমতা, মায়াবতী, মুলায়ম। দুই মেরুর সরকারের সঙ্গে ছিল উত্তর পূর্বের আঞ্চলিক অনেকেই। ২০১৪-য় বিজেপি একক নিরঙ্কুশ হয়ে আসায় সেই ধারাবাহিকতায় ছেদ পড়ে। কিন্তু এডিএমকে, টিডিপি, টিআর এস, বিজেডিকে নানা ভাবে সঙ্গে নেন মোদী। এত দিন পর হিন্দি নিয়ে ফের উত্তর-দক্ষিণ মেলবন্ধনের সূক্ষ্ম তন্তু ছিঁড়ে যেতে বসেছে। যার মূল্য চোকাতে হতে পারে মোদীকে।