দেশে মোদী সরকার দ্বিতীয়বারের জন্য ক্ষমতায় ফিরতেই, আসামে ফের রমরমিয়ে চলতে শুরু করেছে ‘বিদেশি’ বাছাইয়ের ব্যবসা। আর চলবে না-ই বা কেন? এই ব্যবসায় যে বিন্দুমাত্রও পুঁজির প্রয়োজন নেই। রয়েছে অঢেল রোজগার বা কর্মসংস্থানের সুযোগ। আইনি ডিগ্রি বা পুলিশের পোশাক থাকলে তো কথাই নেই। না থাকলেও চলবে। শুধু মাথার ওপর চাই বিজেপি নেতাদের হাত। সঙ্গে চাই উগ্র অসমিয়া জাত্যভিমান। তাহলেই রমরমা বাজার। এভাবেই আসামে এখন ভাষিক বা ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের গায়ে বিদেশি তকমা লাগানোর কারবারে রোজগার বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বাড়ছে প্রতিপত্তিও।
এই ‘বিদেশি’ কারবারের তিনটি স্তর। প্রথম স্তর এলভিও (লোকাল ভেরিফিকেশন অফিসার)। সাধারণত বর্ডার পুলিশের এসআই বা এএসআইরা এই দায়িত্বে থাকেন। কেউ অভিযোগ করলেই শুরু হয় তাঁদের কাজ। নির্দিষ্ট তিন রকম ফর্ম রয়েছে। সেগুলি ভর্তি করে নিজের মন্তব্য-সহ বর্ডার পুলিশের এসপির কাছে পাঠানোর কথা তাঁর। স্থানীয় মানুষ কোনও সংখ্যালঘুকে বাংলাদেশি বলে হয়রান করতে চাইলে তাঁর কাছেই অভিযোগ দায়ের করতে হয়। এলভিও-র পাশাপাশি ‘সবকা বিকাশ’-এর যুগে সাধারণ মানুষেরও রোজগারের দরজা খোলা। সেখান থেকে রিপোর্ট যায় এসপির কাছে।
এলভিও-র পাঠানো রিপোর্ট খতিয়ে দেখার কথা সীমান্ত পুলিশের এসপির। তার পর তিনি রেফারেন্স পাঠান জেলা ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালে। ৩৩টি জেলাতেই রয়েছেন বর্ডার এসপিরা। রয়েছে ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালও। আরও এক হাজার ট্রাইব্যুনাল খুলবে রাজ্য সরকার। ফলে আরও কর্মসংস্থানের সুযোগ। এই ট্রাইব্যুনালের বিচারকেরা দু’বছরের জন্য নিযুক্ত হন। অবসরপ্রাপ্ত জেলা বিচারকদের পাশাপাশি ৭ বছর আইনি পেশার অভিজ্ঞতা থাকলেই নিয়োগ পাওয়া যায় ট্রাইব্যুনাল বিচারকের। তবে ১৯ জন ট্রাইব্যুনালের বিচারককে পুনর্নিয়োগ দেওয়া হয়নি। কারণ এঁরা বিদেশি শনাক্ত কম করেছেন। ফলে ধরে নেওয়া যায় তাঁদের ‘পারফরমেন্স’ ভাল নয়।
সম্প্রতি মরিগাঁওয়ের আমির হোসেনকে ট্রাইব্যুনাল বিচারক গৌতম সৌরেন বিদেশি বলে ঘোষণা করেছে। আমিরের অভিযোগ, তাঁর কাছে ২ লাখ টাকা ঘুষ চাওয়া হয়েছিল। দিতে পারেননি। তাই তিনি ‘বিদেশি’। অসমিয়া প্রতিদিন-এর খবর অনুযায়ী, মরিগাঁও ট্রাইব্যুনালও স্বীকার করেছে বিদেশি শনাক্ত করাটা এখন শিল্পের চেহারা নিয়েছে। প্রতিটি স্তরেই চলছে লুটপাট। অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে প্রক্রিয়া শুরুর বিষয়টি অনেকটাই ফরেনার্স ট্রাইব্যুনালের বিচারাধীন। ট্রাইব্যুনাল অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা বিচার করে বিজ্ঞপ্তি জারি করে।
অভিযুক্তের কাছে নোটিস পৌঁছোনো বা তাঁর নাগরিকত্ব প্রমাণের যাবতীয় উদ্যোগের সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছেন আরও অনেকে। সেখান থেকেও রয়েছে রোজগারের সম্ভাবনা। সংখ্যালঘুরা শিকার হলেও, গোটা আসাম জুড়ে কর্মসংস্থানের নতুন উদ্যোগ শুরু হয়েছে। বিদেশি শনাক্তকরণ রাজ্যের খিলঞ্জিয়া (ভূমিপুত্র)–দের রোজগারের নতুন দিশা দেখাচ্ছে। সম্প্রতি অবসরপ্রাপ্ত ফৌজি ক্যাপ্টেন মহঃ সালাউদ্দিনের প্রসঙ্গ সামনে আসতেই বিষয়টি আরও স্পষ্ট হয়। সালাউদ্দিনের হয়ে মামলাটি লড়ছেন গৌহাটি হাইকোর্টের বিশিষ্ট আইনজীবী হাফিজ চৌধুরি।
তিনি জানান, কীভাবে এই ফৌজি কর্তাকে বিদেশি তকমা লাগিয়ে বিদেশি বন্দীশালায় ভরা হয়। চন্দ্রমল দাস নামে এক এলভিও ২০০৮ সালের ২৩ মে সালাউদ্দিনের নামে এসপিরর কাছে রিপোর্ট পাঠান। তাঁর রিপোর্টে দেখা যায়, সালাউদ্দিন নিজেকে বাংলাদেশি পরিচয় দিয়ে টিপসইও করেছেন। অথচ রেকর্ড বলছে, সেই সময়ে সালাউদ্দিন ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর হয়ে মণিপুরে জঙ্গী দমন অভিযানে কর্মরত। শুধু তা-ই নয়, হাফিজ চৌধুরি জানান, বিদেশি ট্রাইব্যুনাল তাঁর রায়ে বলেছে, সালাউদ্দিনের জন্ম ’৬৭ সালে। আর রেকর্ড বলছে ’৭৮ সালে সালাউদ্দিন ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েছেন।
প্রশ্ন উঠছে, তিনি কি ১১ বছরে সেনাবাহিনীর চাকরি পেয়েছেন? সালাউদ্দিন তো উদাহরণ মাত্র। আসামে এ ধরনের ঘটনা আকছার হচ্ছে। হাফিজ চৌধুরি আরও জানান, সালাউদ্দিনের ঘটনা প্রকাশ্যে আসতেই সেই সময়ের এলভিও চন্দ্রমল দাস দাবি করেন, তিনি নাকি অন্য সালাউদ্দিনের নামে রিপোর্ট দিয়েছিলেন। কিন্তু জানা গেছে, সালাউদ্দিন নামে আশপাশের গ্রামেও কেউ নেই। শুরু থেকেই ‘বিদেশি’ কারবারের ‘পণ্য’ তিনি। রাষ্ট্রপতি পুরস্কারপ্রাপ্ত সালাউদ্দিনকে এখন ‘বিদেশি’ তকমা লাগিয়ে পোরা হয়েছে জেলে।
ইতিমধ্যেই, নলবাড়ি বিদেশি ট্রাইব্যুনালের ১২টি রায় খারিজ করে গুয়াহাটি হাইকোর্ট ট্রাইব্যুনালের কাজকর্ম নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেছে, ‘ট্রাইব্যুনালের কাজে আমরা হতাশ।’ আসামের বিরোধী দলনেতা দেবব্রত শইকিয়া বলেন, ‘রাজ্য সরকার বৈধ ভারতীয় নাগরিকদের প্রতিও নিরপেক্ষ নয়। দুর্ভাগ্যজনক। সংখ্যালঘুরা বিজেপির আমলে মোটেই নিরাপদ নন। এনআরসি বা বিদেশি ট্রাইব্যুনালের নিরপেক্ষতা নিয়ে কংগ্রেস গোড়া থেকে সরব।’ আর হাফিজের মতে, এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত সকলকে শাস্তি না দিলে এ হেন হয়রানি চলতেই থাকবে। জেল খাটতে হবে বৈধ নাগরিকদেরও। সেই সঙ্গে চলবে গরিব মানুষদের ভিটেমাটি বিক্রি করে নিজেদের নাগরিকত্ব টিকিয়ে রাখার বৃথা লড়াই। কারণ একটা সময় পর তাদেরও গ্রাস করবে ‘বিদেশি’ ব্যবসা।