গত ৩০মে শপথ গ্রহণ করেছেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যরা। এর মধ্যেই শিক্ষা নীতি নিয়ে বিতর্কের মুখে কেন্দ্র। অভিযোগ, হিন্দি ভাষাকে জোর করে চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে সারা দেশে। দেশ জুড়ে সমস্ত রাজ্যে এই নীতি প্রয়োগের প্রস্তাব উঠলেও, প্রতিবাদে সব চেয়ে বেশি সরব হয়েছে দক্ষিণী রাজ্যগুলি৷ এমনকী, তামিলনাড়ুতে হিন্দি ভাষা আবশ্যিক করা হলে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধ হবে বলেও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন ডিএমকে সুপ্রিমো এম কে স্ট্যালিন৷ তাঁর দাবি, তামিলদের রক্তে হিন্দির কোনও স্থান নেই৷
শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়। তাই জাতীয় শিক্ষা নীতি প্রণয়ন করে দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বৃহত্তর রূপরেখা ঠিক করে দেওয়ার অধিকার কেন্দ্রের হাতে। কিন্তু কোনও রাজ্য তাদের স্কুলে কোন ভাষায় পড়াবে, তা ঠিক করার অধিকার কেন্দ্রের আদৌ আছে কি না, সেই প্রশ্ন উঠছে। কর্নাটকের শিক্ষাবিদ অশ্বিন বা রাজ্যের শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের মতে, এই সুপারিশের অর্থই হল রাজ্যগুলির উপরে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া। যা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পরিপন্থী।
বারেবারে প্রশ্ন উঠছে যে, অ-হিন্দীভাষি রাজ্যগুলিতেও হিন্দী শেখার কি প্রয়োজন? সমস্ত রাজ্যে এভাবে কোনও নির্দিষ্ট ভাষা পড়াতেই হবে, এমন জোরজুলুম কি কেন্দ্র করতে পারে? তাই এহেন অবান্তর নিয়মকে মানছেন না প্রায় কেউই। তামিলনাড়ুর এডিএমকে সরকারের শিক্ষামন্ত্রী কেএ সেঙ্গোত্তাইয়ান জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা কেন্দ্রের এই নীতি মানবেন না। কেন্দ্রের শিক্ষা নীতির খসড়ায় স্কুলে তিনটি ভাষা শেখানোর কথা বলা হয়েছে। কিন্তু সেঙ্গোত্তাইয়ান বলছেন, ‘‘তামিলনাড়ু দু’টি ভাষার নীতি নিয়েই চলবে। শুধু তামিল ও ইংরেজিই শেখানো হবে।’’ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ই পলানিস্বামী নিজে প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি লিখছেন। ডিএমকে নেতা এমকে স্ট্যালিন বিজেপিকে বিপর্যয়ের হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। এমডিএমকে নেতা ভাইকো-র হুমকি, ফের ভাষাযুদ্ধ শুরু হবে। কমল হাসনের বক্তব্য, ‘‘আমি নিজে হিন্দি ছবিতেও অভিনয় করেছি। কিন্তু হিন্দি চাপিয়ে দেওয়া ঠিক নয়।’’ টুইটারে #StopHindiImposition আন্দোলনও শুরু হয়েছে। বিরোধীদের অভিযোগ, শিক্ষায় গৈরিকীকরণের লক্ষ্যে সঙ্ঘ পরিবারের বরাবরের কৌশল— ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’। নয়া শিক্ষা নীতির খসড়ায় তার প্রতিফলন।
এই প্রসঙ্গে মুখ খুলেছে তৃণমূলও। আজ পার্থবাবু বলেন, ‘‘শিক্ষা যৌথ তালিকাভুক্ত বিষয়। কিন্তু রাজ্যগুলির সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই এক তরফা ভাবে ওই শিক্ষানীতি তৈরি করেছে কেন্দ্র। যা যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর বিরুদ্ধে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ওই নীতি মানে না। রাজ্য ওই নীতির বিরোধিতা করবে।’’ তৃণমূল সূত্রের খবর, ডিএমকে, বিজেডির মতো দলগুলির সঙ্গে জোট বেঁধে এ নিয়ে সংসদে সরব হওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের। শুধু তৃণমূলই নয়, মুখ খুলেছেন বাংলার বিদ্বজনেরাও। সাহিত্যিক নবনীত দেবসেন জানিয়েছেন, “ সাহিত্য অ্যাকাডেমি স্বীকৃত ২৪টা ভাষারই সমান মর্যাদা। তাহলে শুধু হিন্দী ভাষাকে অধিক প্রাধান্য কেন? দক্ষিণ ভারতের খুব অসুবিধা হবে”। একই মত শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়েরও। তিনি জানাচ্ছেন, “ এই নীতি সমর্থনযোগ্য নয়। তবে গৈরিকীকরণের আগে থেকেই হিন্দী চাপানোর চেষ্টা চলছে”।
বিজেপি বিরোধী অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বক্তব্য হল, দীর্ঘদিন ধরেই সঙ্ঘ পরিবার গোটা দেশে ‘হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান’ নীতি প্রণয়নের পক্ষে। সঙ্ঘ পরিবারের অন্যতম লক্ষ্য হল, গোটা দেশের জন্য শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে হিন্দিকে অভিন্ন ভাষা হিসেবে তুলে ধরা। দেশের প্রত্যেকটি পড়ুয়া যাতে হিন্দি শিখতে বাধ্য হয়, তার জন্যই কৌশলে ওই নীতি আনা হয়েছে বলে মত কর্নাটকের যুব কংগ্রেস নেতা শ্রীবৎসের। তাঁর পাল্টা প্রস্তাব, ‘‘কেবল দক্ষিণ ভারতের উপর হিন্দি না চাপিয়ে কেন্দ্রের উচিত হিন্দিভাষী রাজ্যগুলির স্কুলে অন্তত একটি দ্রাবিড় ভাষা শেখানো।’’ নাসার প্রাক্তন বিজ্ঞানী তথা শিক্ষাবিদ অশ্বিন মহেশের কথায়, ‘‘কেন্দ্রের নিয়োগ করা কমিটি রাজ্যগুলিকে পরামর্শ দিয়ে বলছে, তাদের কী করণীয়। অথচ সংবিধান অনুসারে সেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার শুধু রাজ্যের।’’
শশী থারুর বলেছেন, দক্ষিণ ভারতে বেশিরভাগ ছেলেমেয়ে সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসাবে হিন্দি শেখে। কিন্তু উত্তর ভারতের স্কুলে মালয়ালম বা তামিল শেখানো হয় কি? খসড়া শিক্ষানীতি নিয়ে রবিবারও উত্তপ্ত হয়েছে দক্ষিণ ভারত। কর্ণাটকের মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি কুমারস্বামী ও কেরলের কংগ্রেস এমপি শশী তারুর এদিন হুমকি দিয়ে বলেছেন, কোনও শক্তি যদি আমাদের ওপরে জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দিতে চায়, ফল ভালো হবে না। শনিবার প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী পি চিদম্বরম ও ডিএমকে নেতা এম কে স্ট্যালিনও একই ভাষায় কেন্দ্রীয় সরকারকে সতর্ক করেছিলেন।
সারা দেশে তেমন না হলেও, দক্ষিণী বিভিন্ন রাজ্যে নিজেদের আঞ্চলিক ভাষাকেই গুরুত্ব দেওয়া হয়৷ কিন্তু নতুন শিক্ষানীতির খসড়া বাস্তবায়িত হলে তামিলনাড়ু, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালা, কর্নাটকে আঞ্চলিক ভাষাটি তৃতীয় ভাষার মর্যাদা পাবে, যা তাদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব নয় বলে রাজ্যগুলি জানিয়ে দিয়েছে৷ এমডিএমকে নেতা ভাইকোর মন্তব্য, ‘এটা ভাষা যুদ্ধ’৷ তাদের স্পষ্ট ঘোষণা, তামিলনাড়ু তামিল ও ইংরেজি ছাড়া আর কোনও ভাষা স্কুলে পড়ানো বাধ্যতামূলক করা হবে না।