কাল রাতেই খবরটা শুনে মনখারাপ হয়ে গিয়েছিল আমার। ছোটবেলায় সিংহের ছবির তলায় লেখা থাকতো পশুরাজ সিংহ। শেষমেশ কুকুরের ছানার মত সেই সিংহ শাবকরাও কিনা হয়ে উঠলো কেনাবেচার জিনিস? কথায় আছে মারি তো গণ্ডার, লুটি তো ভাণ্ডার। সেই কথাটাই এখন যেন হয়ে গেছে – বেচবো তো বেচবো বাঘ- সিংহ বেচবো। মহাভারতে পড়েছিলাম খাণ্ডব দহনের সময় অগ্নিদেবের ভয়ে পালাচ্ছিল বনের সব প্রাণী। ঠিক সেরকম এখন চোরা শিকারি ও বন্যপ্রাণ কারবারিদের ভয়ে পালাচ্ছে বাঘ, সিংহ সমেত স্থলে-জলে-আকাশে বিচরণ করা পৃথিবীর তাবৎ প্রাণীকুল। সিংহ শাবকেরও নিস্তার নেই, তাকেও প্রায় গ্যালিফ স্ট্রিটের পশুপাখি বাজারের জিনিস করে তুলেছে এই কারবারিরা।
আরও মনখারাপ হল অভিযুক্তদের জামিন পাওয়ার খবরে। বন্যপ্রাণ বিশেষজ্ঞ এক বন্ধু আমায় আজ সকালেই বললেন, সিংহ, বন্যপ্রাণ সংরক্ষণ আইনের শিডিউল ওয়ান তালিকাভুক্ত প্রাণী। এই ধরনের প্রাণী পাচার করার অভিযুক্তদের কোন কারণ না দেখিয়ে তিনমাস আটক রাখা যায়। এটা জামিন অযোগ্য অপরাধ। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ৭ বছর জেল এবং ২৫ লাখ টাকা জরিমানা। আমার অবাক লাগছিল তা সত্বেও অভিযুক্তরা জামিন পেলেন কীভাবে? বন্ধুটি জানালেন, হয়তো বিচারককে ঠিকভাবে ব্রিফ করা হয়নি বা কোন সরকারি উকিল ছিলেন না।
আমার নিজেরও আর একটা কথা মনে হল, নির্বাচন পরবর্তী সময়ে সর্বত্র একটা প্রশাসনিক ঢিলেমি দেখছি। উচ্চপদস্থ আমলারা কেমন যেন চুপ মেরে গেছেন। তারা যেন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারছেন না। এই ঘটনা তারও একটা কারণ হতে পারে। খবরের কাগজে পড়লাম, পাচারকারীদের গাড়িতে একটা রাজনৈতিক দলের পতাকা ছিল। পুলিশের নজর এড়ানোর জন্যই তা করা হয়েছে। আমার মনে হয়, এই ব্যাপারটা নিয়ে তদন্ত হওয়া উচিৎ। কোন দলের পতাকা ছিল তা সামনে আসা দরকার। অভিযুক্তদের বিচারের ব্যাপারে যেন কোন রাজনৈতিক পক্ষপাত না থাকে।
বন্যপ্রাণ পাচারকারীরা অনেক সময় বাংলাকে পাচারের একটা করিডোর হিসেবে ব্যবহার করে। পাকিস্তান, বাংলাদেশ, নেপাল হয়ে চিন পর্যন্ত বিস্তৃত এই করিডোর। সাংস্কৃতিক বিপ্লবের চিনে এখন বাঘ থেকে তক্ষক, প্যাঙ্গোলিন, হর্নবিল ইত্যাদি পশুপাখির বিরাট বাজার। এগুলি থেকে নানারকম যৌবনবর্ধক ওষুধ ও তেল তৈরি হয়। আরেকটা সূত্রের মতে, পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ হয়ে পশ্চিমবঙ্গে ঢোকে পাচারকারীরা। আরব, দুবাই, পাকিস্তানে নাকি একশ্রেণীর ধনী ও মাফিয়া ডনেদের বেড়াল পোষার মতই সিংহ পোষার চল আছে।
আমার প্রশ্ন, আমাদের সীমান্তে গরু, ধান, নুন, জামাকাপড় পাচারকারীদের ধরতে তৎপর বিএসএফের নজর এড়িয়ে এরা ঢুকলো কীভাবে? তাদের ধরা এবং পালানোর সময় গুলি চালানোর ব্যাপারে বিএসএফ তো সদা তৎপর। তবুও এই ঘটনা ঘটলো কীভাবে? সিংহ শাবক তো গরুর মত পাচার করা যাবে না। গোটা অপারেশনটা দেখে আমার মনে হচ্ছে এটা একটা নিয়মিত ব্যাপার। এই ঘটনাটার একটা পূর্ণাঙ্গ তদন্ত হওয়া উচিৎ।
বন ও বন্যপ্রাণ আমার একটা ভালবাসার ব্যাপার। জীবনের একটা বড় সময় আমার বন জঙ্গলে কেটেছে। ছবি তোলার শুরুর দিকে বন্যপ্রাণ ও জঙ্গলের ছবি তোলার জন্য অরণ্যে যাওয়া আমার একটা নেশার মত ব্যাপার ছিল। সেই ছবির স্বীকৃতি হিসেবে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট আমাকে তিনবার পুরস্কৃত করেছিল। কাজেই এই ধরণের ঘটনা ঘটলে আমার প্রতিক্রিয়া তো হবেই। এই লেখাটা লিখতে লিখতে আমার কেকের কথা মনে পড়ছে। কেকে রায় আমার বন্ধু, পিটিআইয়ের ফোটোগ্রাফার, কয়েক মাস আগে ও মারা গেছে। আমার মত কেকেরও ছিল জঙ্গলের নেশা। ছবি তোলার সূত্রে ও আর আমি একসঙ্গে বহু জঙ্গলে ঘুরেছি। আমি জানি, কেকে বেঁচে থাকলে এতক্ষণে ওর বেশ কয়েকটা ফোন চলে আসতো, ফোনে ক্ষোভ জানাতো সে।
একটা জিনিস আমি লক্ষ্য করেছি আমাদের দেশে অরণ্য ও বন্যপ্রান সংরক্ষণ সংক্রান্ত আইন যারা ভাঙেন তাদের চাঁইরা খুব ক্ষমতাশালী মানুষ, আইনের ফাঁক দিয়ে বেরিয়ে যান তারা। ধরা হয় জঙ্গলে কাঠকুটো কুড়িয়ে দিন গুজরান করা কিছু গরিব আদিবাসী মানুষদের। আমি চাই এই চক্রের পিছনে যারা রয়েছে তাদের ধরা ও শাস্তি দেওয়া হোক। পশুপাখির কারবার ঠেকাতে এবং স্বাভাবিক বাসস্থান ও পরিবেশ থেকে তাদের বের করে এনে পোষার মত নৃশংসতা রোখার সচেতনতা তৈরি হোক মানুষের।
ছোটখাটো প্রাণী ছেড়ে এখানকার বন্যপ্রাণ কারবারিরা আরও বড় কারবারে হাত বাড়াচ্ছে। বাংলায় এই প্রথম পাচারকারীদের কাছ থেকে সিংহ ধরা পড়লো। প্রাণী বৈচিত্র কিংবা জাতীয় সম্পদ নয় কারবারিদের কাছে তা স্রেফ একটা বেচার জিনিস। এই ব্যবসা বাড়তে দিলে শুধু ভারত নয়, পৃথিবী থেকেই একদিন সমস্ত বন্যপ্রাণ তাদের স্বাভাবিক বাসস্থান থেকে বিলুপ্ত হবে। তাদের দেখা পাবো আমরা শুধু চিড়িয়াখানা, ছবির বই আর ধনীদের প্রাইভেট জু তে। বন্যপ্রাণ বিলুপ্তির প্রভাব কিন্তু মানুষের ওপরও পড়বে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত