আজ দুপুরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে বিজেপির একের পর এক আসনে এগিয়ে থাকার খবরে আমাদের অনেকেরই মনখারাপ। হাঁটতে হাঁটতে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম, দুপুরের ফাঁকা রাজপথ, দিদির বাড়ির টালির চালের ওপর আপন খুশিতে উড়ছে তৃণমূলের পতাকা। সেই ওড়াতে যেন রয়েছে এক আশ্বস্ত ভাব। উড়তে উড়তে সে যেন বলছে, দেখো, অন্য রাজ্য তছনছ করে দিলেও বাংলায় এসে বিজেপির বিজয়রথ আটকে গেছে। বহু চেষ্টার পরও বিজেপি বাংলায় তৃণমূলের আসন সংখ্যাকে ছাপিয়ে যেতে পারেনি।

নির্বাচনের ফল নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে, খুব তাড়াতাড়ি তা শেষও হবে না। আমার এই বিশ্লেষণে যোগ দেওয়ার মত কোন যোগ্যতা নেই, তবে সামান্য একটি কথা আমি বলতে পারি বিজেপির এই সাফল্যের কারণ কিন্তু তাদের আদর্শ, কাজ কিংবা সাংগঠনিক শক্তি কোনটাই নয়। আমার মতে, এবারের নির্বাচনে বিজেপির সাফল্যের মূল কারণ হল, দেশের বিরোধী দলগুলির অনৈক্য এবং শুধুই সাময়িক লাভের দিকে তাকিয়ে দেশের ভবিষ্যৎ বুঝতে অস্বীকার করা। দেশের মানুষকে বিজেপি নামে বিপজ্জনক দলটির শাসন ক্ষমতায় ফিরে আসার বিপদ বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে বিরোধীরা।
কলকাতায় ইউনাইটেড ফ্রন্টের ডাক দিয়ে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিজেপির বিরুদ্ধে বিরোধী দলগুলিকে নিয়ে যে দেশজোড়া যৌথ প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন তার তাৎপর্যই অনেক শরিকই বুঝতে পারেননি। তারা শুধু ব্যস্ত ছিলেন রাজ্যভিত্তিক সঙ্কীর্ণ স্বার্থ নিয়ে। বস্তুত বিজেপির বিরুদ্ধে দেশে কোন বিরোধী ঐক্য তৈরিই হয়নি। যৌথ প্রচেষ্টার বদলে কিছু দলের নেতারা প্রধানমন্ত্রীর পদ দখলের জন্য লবি করতে শুরু করেছিলেন। বিজেপি এর সুযোগ নিয়ে একদিকে যেমন বিরোধীদের ঐক্যকে দুর্বল করেছে ঠিক তেমনি এনডিএর শরিক দলগুলির মধ্যে ঐক্যকে আরও সংহত করেছে। এব্যাপারে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সতর্কবার্তাকে ইউনাইটেড ফ্রন্টের শরিকরা অনেকেই তেমন আমল দেননি।
বাংলার উন্নয়নের জন্য দিদি যা করেছেন তা গ্রামগঞ্জে ঘুরে আমি নিজের চোখে দেখেছি। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য, সড়ক থেকে বিদ্যুৎ, স্বনির্ভরতা থেকে কর্মসংস্থান সব মিলিয়ে রাজ্যে যে উন্নয়ন তিনি করেছেন তার সুফল এখন গ্রাম-শহরের বহু মানুষ পাচ্ছেন। কিন্তু এত উন্নয়ন সত্বেও এই ফল হয় কী করে! তাহলে উন্নয়নের কী কোন অর্থ নেই? খুবই হতাশ লাগছিল, একটু ভেবে এই প্রশ্নের জবাব পেলাম। পুলওয়ামা আর বালাকোটের পর দেশে এক উগ্র ধর্মান্ধতার জিগীর তুলেছিলেন মোদি-অমিতরা। ধর্ম, জাতপাতের রাজনীতিতে বিভ্রান্ত হয়েছিল মানুষ। সেই চক্রান্তের সামনে গ্রামগঞ্জে নীরবে ঘটে চলা উন্নয়ন দাঁড়াতে পারেনি।
নির্বাচনে হার-জিৎ থাকবেই কিন্তু হারা কিংবা জেতা নিয়ে কোন রাজনৈতিক দল চলে না। যে কোন রাজনৈতিক দলের লক্ষ্য হল, একটা আদর্শ ও কর্মসূচীর ভিত্তিতে দেশের বিকাশ ও মানুষের উন্নয়নের লক্ষ্যে কাজ করা। বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তৃণমূল কংগ্রেসকে সেই লক্ষ্য পূরণের জন্যই গড়ে তুলেছেন। কিন্তু খুব দুঃখের সঙ্গে লক্ষ্য করছি, এই আদর্শবোধটাই এখন নানা কারণে হারিয়ে যাচ্ছে। নির্বাচনী বিপর্যয়ের কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেছেন, পরিস্থিতির পর্যালোচনা করে নতুনভাবে এগোনোর কথা। একদম ঠিক কথা, এ সময় আত্মসমালোচনার সময়। এখন বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর পাশে আরও সক্রিয়ভাবে থাকতে হবে আমাদের সবাইকে। টালির চালের মাথায় নির্ভীকভাবে উড়তে থাকা পতাকাটা আমাকে যেন সেই কথাটাই মনে করিয়ে দিল। সে যেন বললো, নির্বাচনে দলের আসন সংখ্যা কমাকে আদর্শের পরাজয় বলে ধরে নিও না।
সংখ্যার শক্তিকে ছাপিয়ে যাবে আদর্শের শক্তি। দিদির নেতৃত্বে তৃণমূল কংগ্রেস আবার তা প্রমাণ করে দেবে।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত