গতকাল প্রকাশিত হয়েছে মাধ্যমিকের ফলাফল। এ বছর পূর্ব মেদিনীপুরের মহম্মদপুর দেশপ্রাণ বিদ্যাপীঠের ছাত্র সৌগত দাস ৬৯৪ নম্বর পেয়ে প্রথম স্থান অধিকার করেছে। যুগ্ম দ্বিতীয় হয়েছে শ্রেয়সী পাল এবং দেবস্মিতা সাহা। তাদের প্রাপ্ত নম্বর ৬৯১। বহুদিন ধরে কঠোর অধ্যবসায়ের মাধ্যমে তাঁরা এই সাফল্যের অধিকারী হয়েছে। ওরা ইচ্ছাপ্রকাশ করেছে ডাক্তার হওয়ার। আর বিপত্তি সেখানেই। তাঁদের এই ইচ্ছাপ্রকাশের ফলে গতকাল দিনভর কুৎসিত ‘ট্রোলের’ শিকার হতে হল তাঁদের আর ট্রোল করলেন স্বয়ং চিকিৎসকেরা!
সংবাদমাধ্যমের কাছে সাক্ষাৎকার দিয়ে গিয়ে দু’জনই জানিয়েছে, ভবিষ্যতে তারা ডাক্তার হতে চায়। তারপরই এই দুই কৃতির স্বপ্নকে কটাক্ষ করতে শুরু করেছেন কিছু চিকিৎসক। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁদের সেই কটাক্ষ ঘিরে স্বভাবতই চাঞ্চল্য ছড়িয়েছে। দু’টি ক্ষেত্রেই প্রথম পোস্ট করেন শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. প্রভাসপ্রসূন গিরি। তিনি ফার্স্ট বয় সৌগতকে প্রশ্ন করেন, “বাবুসোনা তুমি কি পাগল? নাকি তোমার পেট খারাপ? ডাক্তার হতে চেয়ে আত্মহত্যা করার এত ইচ্ছে কেন? তা-ও আবার এই দেশে, এই রাজ্যে!’
এরকম অবমাননাকর একটি পোস্ট ভাইরাল হতে বেশি সময় লাগেনি। প্রায় ২৪জন কমেন্ট করেছেন এই অত্যন্ত কুরুচিকর এই পোস্টটিতে। যাঁদের ৯০ ভাগই ডাক্তার। কেউ বলেছেন, “দাদা, ওর খুজলি হয়েছে। মলম লাগাতে হবে।” কেউ আবার কমেন্ট করতে গিয়ে ভাষার ভারসাম্য হারিয়েছেন। বলেছেন, “হয়ে গেল। বাঁশ কেন ঝাড়ে এসো আমার…”। কেউ আবার বলেছেন, “স্যারদের হাতে তো মার খাওনি। এবার জনগণের হাতে মার খাওয়ার জন্য তৈরি হও।’ ডা. দেবাশিস চট্টোপাধ্যায় জানিয়েছেন, ‘‘এই বয়সে মানসিক সমস্যা একেবারেই ঠিক না। বাড়ির লোকের বোঝানো উচিত।’’
ডেন্টিস্ট দীপাঞ্জয় ঘোষ কমেন্ট করেন, “আহ, ছেলেটা মরতে চাইছে যখন মরতে দিন না”। ডা. বিশ্বম্ভর আগরওয়ালের উক্তি, “মহামুর্খ ছাড়া কেউ ডাক্তার হতে চায় না”। বিনা মূল্যে ডাক্তারি করার ইচ্ছা প্রকাশ করায় প্রভাসপ্রসূনবাবু মঙ্গলবার শ্রেয়সীকেও কটাক্ষ করেন। প্রশ্ন করেন, “বিনামূল্যে চিকিৎসা! খাবে কী? মার? মার খেয়েই পেট ভরে যাবে? ওষুধও কি বিনামূল্যে কিনে দেবে? যদি সরকারি চাকরি করে তাহলে ও কি মাইনে নেবে না? সবাইকে বিনামূল্যে দেখলে নিজের অন্নসংস্থান হবে কী করে?”
কলকাতার চিকিৎসক ডা. গৌরগৌতম কর কৃতীর বাবা-মাকে কটাক্ষ করে লিখেছেন, “আশা করি কৃতীর বাবা-মা ওর জন্য প্রচুর জমিয়ে রেখে যাবেন। আর সংসারী হলে স্বামীও বিনা রোজগারে চিকিৎসা সাপোর্ট করবেন। তাহলে ও নিশ্চয়ই পারবে!” প্রভাসপ্রসূণবাবু অবশ্য সাফাই গেয়েছেন, “শ্রেয়সী বিনামূল্যে ডাক্তারির কথা বলায় যেভাবে প্রবল হাততালির ঢেউ শুরু হয়েছিল, তার প্রেক্ষিতেই পোস্ট দু’টি করেছি। ডাক্তাররা কতটা হতাশ পোস্টের কমেন্টগুলি দেখলেই বুঝবেন।”
অবশ্য অন্য মতও আছে। মেদিনীপুর কলেজের এক অধ্যাপক ফটিকচাঁদ ঘোষ অবশ্য ডাক্তারদের পাল্টা পরামর্শ দিয়েছেন। তাঁর মত, “মাননীয় ডাক্তারবাবুরা বিনা পয়সায় কথাটাকে একটু অন্যরকম ভাবে দেখুন। ও অন্যায় কিছু বলেনি। বিনা পয়সায় রোগী দেখে ও পাঁচখানা বাড়ি দামি গাড়ি বিদেশ ভ্রমন করতে পারবেনা হয়তো কিন্তু খেতে-পরতে পারবে। এখনও অনেক ডাক্তার পাঁচ টাকা বা পঞ্চাশ টাকায় রোগী দেখেন। একটা বাচ্চা মেয়ের স্বপ্ন ও আবেগ নিয়ে মজা করার অধিকার আপনাদের কেউ দেয়নি।”
পোস্টটি গতকাল সন্ধ্যাপর্যন্ত প্রায় ৫১ টি শেয়ার হয়েছে। নেটিজেনরা প্রশ্ন তুলছেন কিভাবে চিকিৎসকেরা এরকম মন্তব্য করতে পারেন? ওনারা নিজেরা যে পেশায় আছেন সেই পেশাকে কি করে এরকম করে অপমান করতে পারেন! আর মাধ্যমিকে এহেন অসাধারণ ফলের অধিকারী প্রতিভাদের তাঁদের স্বপ্নের পথে এগিয়ে জেতে বাধা সৃষ্টিই বা কি করে করতে পারেন? যেখানে এই কৃতিরা এবার এগোবে নিজেদের লক্ষ্য পূরণে সেখানে শুরুতেই যদি তাঁদের এভাবে দমিয়ে দেওয়া হয়, তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম সাফল্যের আলো দেখবে কি করে?
তবে শুধু চিকিৎসকেরাই নয়, প্রায় প্রতি বছরেই মধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পরে এরকম করেই আক্রমণ করা হয় কৃতিদের। কখনও বা সংবাদ মাধ্যমে তাঁদের বলা কথা যেমন তাঁরা কতক্ষন পড়াশোনা করত বা তাঁরা কি হতে চায় তাই নিয়েও নোংরা ট্রোল, মিমে ছেয়ে যায় সোশ্যাল মিডিয়া। তবে সেই দলে যেভাবে চিকিৎসকেরা তাঁদের নাম অন্তর্ভুক্ত করলেন তা সত্যিই নজিরবিহীন। এই সমস্ত নেতিবাচকতাকে দূরে সরিয়ে নিজেদের লক্ষ্যে এগিয়ে যাক শ্রেয়সীরা, এটাই কাম্য।