ত্রিপুরার বামপন্থী সরকারের পতনের পর, লেনিনের মূর্তি ভেঙে বিজেপি জয়োল্লাস করেছিল। সম্প্রতি ভেঙেছে সুকান্তর মূর্তিও। সেটাই এবার গড়িয়ে এল বাংলায়। কলকাতায় অমিত শাহ-র রোড শো থেকে বিজয় উল্লাস ও পেশীশক্তির প্রদর্শন করতে গিয়ে ভাঙা হল ২০০ বছরের প্রাচীন বিদ্যাসগরের মূর্তি।
নির্বাচনের মারফত গদি দখলের জন্য আজ বিজেপি-আরএসএস যা করছে তা পুরোপুরি এক সমাজবিরোধী কাজ। এটার কাজ করছে শুধু বিরোধী রাজনীতির প্রতি একটা চরম প্যাথোজেনিক ঘৃণা। ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনীতির চাঁইরা প্রচণ্ড বুদ্ধিমান ও ধান্দাবাজ হলেও, ফুট সোলজার বা পদাতিকদের বুদ্ধ্যঙ্ক সাধারণত খুবই কম। এক্ষেত্রেও সেটাই ঘটেছে। বিরোধীদের বার্তা দেওয়ার জন্য বাংলার বুকে বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙার মতো বোকামি আর কিছু হতে পারে না।
শুধু তাই নয়। বিদ্যাসাগরের এই মূর্তির একটা ঐতিহাসিক গুরুত্বও আছে। ১৮৭২ সালে ভারতীয়দের উদ্যোগে বানানো প্রথম বিদ্যালয় এই মেট্রোপলিটন ইনস্টিটিউশন। স্থাপিত হয় ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি। পরে ১৯১৭ সালে ইনস্টিটিউশনের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয় বিদ্যাসাগর কলেজ। সেই কলেজেই চরম আক্রোশে ভাঙচুর চালিয়েছে বিজেপি-আরএসএসের দুষ্কৃতীরা। ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছে ঐতিহ্যমণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি।
মূর্তিভাঙা-র সংস্কৃতি অবশ্য এই বঙ্গে নতুন কিছু নয়। গত শতকের সত্তরের দশকে নকশালদের হাতে প্রথম এই মূর্তিভাঙা শুরু হয়। রাজনৈতিক অর্থে যা ছিল নিতান্ত বালখিল্য। পাইকারি হারে ভাঙচুর, শিক্ষকদের অস্মমান, পরবর্তীকালে কোনও মধুর স্মৃতি রেখে যায়নি। চারুবাবুদের বিপ্লবও দীর্ঘজীবী হয়নি।
মাও-এর লাল ফৌজ যেমন একটি দর্শনের তাড়নায় বা তালিবানরা উগ্র ধর্মীয় ভাবাবেগের তাড়নায় যে মূর্তি ভাঙার উৎসবে মেতেছিল, বিজেপির হাত ধরে সেই উৎসব যেন আবার এই বাংলায় ফিরে না আসে। ইতিহাসের প্রবহমান ধারাকে মেনে চলতে হয়। ত্রুটি উৎপাটন করার অধিকার অবশ্যই আছে, ইতিহাস মুছে ফেলার অধিকার কারও নেই। পেশীশক্তির আস্ফালনে এটা বিজেপির ঐতিহাসিক ত্রুটি। গতিপথে এর ফল বিজেপিকে ভোগ করতেই হবে।
নাস্তিকতার ওপরে আস্তিকতাকে কেউ প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেই পারেন কিংবা তার উল্টোটা। একইভাবে গান্ধীজির ওপর নেতাজিকে, মার্কসের সাম্যবাদের ওপর বৈদিক সাম্যবাদকে, ইহার ওপর উহাকে, উহার ওপর ইহাকে – প্রতিষ্ঠা করতে চাইতেই পারেন। তবে সেটা জ্ঞানের চর্চা দিয়ে হওয়াই ভালো। ভারত ভূমিতে আদিকাল থেকে সেই জ্ঞানের চর্চাই হয়ে আসছে। এ দেশে এটাই মানায়।
তাই মূর্তি ভাঙার প্রতিযোগিতায় নেমে বাতাসে ধুলো না বাড়িয়ে, ভাবমূর্তি ভাঙার প্রক্রিয়া শুরু হোক। লেখায়, কথায় উঠে আসুক আইকনক্ল্যাস্টরা। ভণ্ডামোর অবসান হোক।