উত্তর কলকাতার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিদ্যাসাগর কলেজ কত ইতিহাস, কত স্মৃতি, কত সংগ্রামের ধারক ওবাহক৷ এই কলেজের বয়স প্রায় দেড়শো বছরের বেশি হবে। গতকাল থেকেই বিদ্যাসাগর কলেজ রাতারাতি খবরের শিরোনামে তবে কোনও সুখ্যাতির কারণে নয়৷ যাঁর অনুপ্রেরণায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছে এত বছরের পুরনো এক কলেজ, সেই ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের ঐতিহ্যবাহী মূর্তি ভেঙে খানখান হয়ে গিয়েছে৷ এমন ঘটনায় বিস্মিত, আহত কলেজের শিক্ষক থেকে অশিক্ষক কর্মী, ছাত্রছাত্রী থেকে প্রাক্তনীরা। এই ঘটনায় প্রতিবাদের ডাক দিল প্রাক্তন শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রীরা৷
মঙ্গলবার বিজেপি সভাপতি অমিত শাহের রোড শো ঘিরে রণক্ষেত্র হয়ে ওঠে কলকাতা। বিদ্যাসাগর কলেজের ভিতর প্রবেশ করে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভেঙে টুকরো টুকরো করেছে উন্মত্ত বিজেপি কর্মীরা। এমন ঘটনায় মারাত্মক ক্ষুব্ধ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বিদ্যাসাগরের মূর্তি ভাঙাকে বাঙালির অপমান হিসাবেই দেখছেন তিনি। গেরুয়া শিবিরকে নিশানা করে তাঁর হুঁশিয়ারি, “ওরা বাংলার হেরিটেজ, বাংলার মনীষীর গায়ে হাত দিয়েছে। আমার থেকে ভয়ঙ্কর কেউ হবে না। তোমাদের ঔদ্ধত্য খর্ব করবই”। মঙ্গলবার সন্ধের ঘটনায় আপামর বাঙালির মাথা নত করে দিয়েছে৷
বাঙালি জাতি যাকে শ্রেষ্ঠ বাঙালি বলে চিহ্নিত করেছেন, যাকে রবীন্দ্রনাথের থেকেও আগে রেখেছেন। তিনি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ তাঁর সম্পর্কে বলেছেন, “তাঁর দেশের লোক যে যুগে বদ্ধ হয়ে আছেন, বিদ্যাসাগর সেই যুগকে ছাড়িয়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। অর্থাৎ সেই বড় যুগে তাঁর জন্ম, যার মধ্যে আধুনিক কালেরও স্থান আছে, যা ভাবীকালকে প্রত্যাখ্যান করে না। যে গঙ্গা মরে গেছে তার মধ্যে স্রোত নেই, কিন্তু ডোবা আছে, বহমান গঙ্গা তার থেকে সরে এসেছে, সমুদ্রের সঙ্গে তার যোগ। এই গঙ্গাকেই বলি আধুনিক। বহমান কালগঙ্গার সঙ্গেই বিদ্যাসাগরের জীবনধারার মিলন ছিল, এই জন্য বিদ্যাসাগর ছিলেন আধুনিক”।
কীভাবে নিন্দা করবে বাঙালি গতকালের ঘটনার? হয়তো কারোর জানা নেই। অমিত শাহের রোড শো ঘিরে এই উত্তাল পরিস্থিতি মেনে নেওতা যায় না। যে দল মানবিকতার পরিচয় দেয় না, মনীষীদের সম্মান করেনা তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কোনও ভাষাতেই এমন একটি ঘটনার সঠিক প্রতিবাদ হয় না হয়ত। যে কোনও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানেই এমন ঘটনা অনভিপ্রেত। আর এক্ষেত্রে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় যে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো। কেবল প্রাচীনত্বের নিরিখেই এটি বিখ্যাত নয়, এর বিখ্যাত হওয়ার আরেকটি কারণ, এটি সম্পূর্ণ ব্রিটিশ অধীনস্থ ভারতের টাকায় তৈরি৷ ভারতীয়দের দ্বারা পরিচালিত প্রথম বেসরকারি কলেজ। আর এর প্রাক্তন ছাত্রতালিকা দেখলে মাথা আপনিই নত হয়ে আসবে যে কোনও শিক্ষিত মানুষের। এমন একটি কলেজের সঙ্গে অন্যায় মেনে নেওয়া কষ্টকর। সেই ঈশ্বরচন্দ্রের ওপর কলকাতায় গতকাল হামলা হলো। সত্যিই আমাদের মুখ লুকানোর জায়গা নেই। মহাপ্রভু, রামকৃষ্ণদেব, যিশু, মহম্মদ, গুরু নানক, বুদ্ধদেব, মহাবীর জৈন – কেউই হিংসার বাণী ছড়াননি। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, জওহরলাল নেহরু, মহাত্মা গান্ধী, অটলবিহারী বাজপেয়ী – প্রত্যেকেই নিজেদের সমালোচনা শোনার ক্ষমতা রাখতেন। হিংসা কোনও পথ দেখায় না।