ঘাটের কাছে এক জায়গায় মোদীর বিরাট ছবি। গাড়ির ওপর দাঁড় করানো। তলায় লেখা ‘মেরা কাশী: বিকাশ কে পথ পর...’। নির্বাচন কেন্দ্রের নাম বারাণসী। তবে মোদী তার পৌরাণিক নাম ‘কাশী’ বলাই পছন্দ করেন। কথায় কথায় বলেন, ‘মেরি কাশী’। তো সেই কাশী কেমন ‘বিকাশকে পথ পর...’ তার প্রমাণ মিলবে ঘাট আর অলি-গলি ঘুরলেই। বরুণা ও অসি। এই দুই নদীর মধ্যবর্তী গঙ্গার তটভূমিই প্রাচীন বাণিজ্যনগরী বারাণসী। এটা কিংবা এর বাইরের বেশ খানিকটা এলাকা নিয়ে একদা মহাজনপদ কাশী। কোশল বা মগধ বলে আজ কিছু নেই, কিন্তু কাশী আছে। বরুণা এখন ক্ষীণতোয়া, অসি শহরের বর্জ্য পদার্থে পুষ্ট একটি নালা।
মণিকর্ণিকার ঘাটে কখনও চিতা নেভে না। কাঠের চুল্লির জন্য সুপ্রিম কোর্টও ছাড় দিয়েছে। দু’-তিনজন ঘাটবাবু। দুধ-চায়ের দোকান। ‘মালিকানাহীন’ গরু, ষাঁড়। দাহ-খরচ ৩৫০০ টাকা। কোনও সরকারি সাহায্য নেই। আরও উঁচুতে শুধু গলিমুখ হঠাৎ আলোকময়। ফাঁকা। মানে একটা দিক খণ্ডহর। চারতলা-পাঁচতলা বাড়ি হাঁটু মুড়ে বসে আছে। মুখ থুবড়ে। ভাঙা ইট কংক্রিটের ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়েছে ফাটল ধরা ভাঙা মন্দির। বিশ্বনাথ মন্দিরের জন্য মোদী তৈরি করেছিলেন বিশ্বনাথ মন্দির বিকাশ পরিষদ। যা নাকি ৬৬৪ কোটি টাকার প্রকল্প। কিন্তু হাতেগোনা কয়েকজন বড় ব্যবসায়ী ছাড়া কেউই খুশি নন এখানে। মুখ খুলছেন না ভয়ে। হরপ্পার ভাঙা ইটের গায়ে অনেক কাহিনি। পাকা বাড়ির এই ধ্বংসস্তূপকে লোকে বলছে ‘পাকাপ্পা’। বিশ্বনাথ মন্দিরে যাওয়ার একটি গলিতে একাদশ শিবমন্দিরের গায়েও মোদীর ছবি। পদ্মচিহ্ন। ভোট দেওয়ার ডাক। আরও অনেক ছোট-বড় মন্দিরেও বিজেপির পতাকা উড়ছে!
বারাণসী আরও বড় হয়েছে। এটাকে আধ্যাত্মিক ও আধুনিক শহর করা হয়েছে। রায়তপুরে লালবাহাদুর শাস্ত্রী এয়ারপোর্ট। পথের ডিভাইডারে আরব থেকে প্রমাণ সাইজের খেজুরগাছ এনে লাগানো হয়েছে। বিদেশি পর্যটকদের ভিড় বেড়েছে। অথচ প্রতিদিন শহরের যাবতীয় বর্জ্য, দূষিত জল কয়েকশো নালা বেয়ে সরাসরি গঙ্গায় মিশছে। তথ্য দিয়ে সরাসরি এই অভিযোগ করলেন সঙ্কটমোচন মন্দিরের মহন্ত বিশ্বম্ভরনাথ মিশ্র। সঙ্কটমোচন ফাউন্ডেশন রাজীব গান্ধীর আমল থেকেই গঙ্গাদূষণ বিরোধী প্রকল্পে যুক্ত। বললেন, ‘গঙ্গা অ্যাকশন প্ল্যান ফেজ-১, ফেজ-২ শেষ। এবার তারই নাম দিল নমামি গঙ্গে। গঙ্গা নিয়ে আলাদা মন্ত্রক। বৈজ্ঞানিক পরীক্ষায় কিন্তু প্রমাণিত, বারাণসীর গঙ্গার জল স্নানেরও যোগ্য নয়।’
বারাণসীতে একটা কথা চালু আছে— ঘরের মধ্যে মন্দির। মন্দিরের মধ্যে ঘর। বিশ্বনাথ করিডরে কত মন্দির ভাঙা পড়েছে, আরও কত পড়বে। ঠাকুর মানুষকে মুক্ত করেন। মোদী ঠাকুরকে মুক্ত করছেন! মোদী অবতারের আসল লক্ষ্য জ্ঞানবাপী মসজিদের কাছে অযোধ্যার মতো লাখো লোক জড়ো করা। গলি থাকলে তো তা সম্ভব নয়। বাবরির বুদ্বুদ তো ফুরিয়ে এসেছে! আবার, বিশ্বনাথ মন্দিরে প্রথম আরতি দেখার জন্য ১২০০ টাকার টিকিট। ভিড় এড়ানোর জন্য ৫০০ টাকার। ৫৫ হাজার টাকার টিকিটে গোটা পরিবার ৭ দিন যজ্ঞ করতে পারবে। মন্দিরের বাণিজ্যিকীকরণ করেছেন মোদীর উৎসাহে যোগী সরকার। মন্দির এবং মসজিদের কাছেই থাকতেন ভারতরত্ন সানাইশিল্পী বিসমিল্লা খাঁ। শহরে কয়েকটি মোড়ে ষাঁড়ের মূর্তি আছে, বিসমিল্লা নেই।
এমনকী মোদির প্রচার–পুস্তিকায় কাশীর সাংস্কৃতিক জগতের মধ্যেও নেই। অথচ মোদির রোড শোয়ে মুসলিম অধ্যুষিত মদনপুরাতে পুষ্পবৃষ্টি হয়েছে নাকি! নিন্দুকেরা বলছেন, টাকা দিয়ে ভাড়া করে লোক আনা হয়েছিল। বাড়ি-বাড়ি গোলাপ পাপড়ির প্যাকেট দিয়ে বলা হয়েছিল পুষ্পবৃষ্টি করতে। দশাশ্বমেধ ঘাটে মাকপা–র রাজ্য দফতরের গা দিয়ে এক গলি আছে। তাতে ঢুকলেই বিশ্বদর্শন। সোনাপুরার বাঙালিটোলা এখানেই। কলকাতার বনেদি বাবুদের বাড়ি। এখন বেহাত। এখন এটা তেলুগু, তামিল মহল্লা। কোনও বাড়ির তলায় গোশালা। আবার আধুনিক বিদেশি রেস্টুরেন্ট। বোর্ডে লেখা— আমেরিকানো, ক্যাপাচিয়ানো, ইতালিয়ানো। মোনালিসা রেস্টুরেন্টে মোনালিসার ছবি, পরনে রাজস্থানি বধূর শাড়ি।
সেখানে মোদীর ভক্ত মাইক হলিডে ভারতীয় সাধুকে ম্যানেজ করে হঠযোগ, থেরাপিউটিক যোগ, রেমিডিয়াল অ্যাস্ট্রোলজির নামে মানুষকে ‘ভাঁওতা’ দিয়ে ভালই কামাচ্ছেন। কেদারজির মন্দিরের গায়ে শঙ্করাচার্য বেদ বিদ্যাপীঠ। সাত বছর থেকেই বেদপাঠের তালিম। অধ্যাপক আদিত্যনাথ শাস্ত্রীর উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানে স্নাতক এখন বেদ গবেষণায় ব্যস্ত। তিনি বলেন, ‘ধর্মের চাকা এবার মোদীকেই তাড়া করবে। যেমন শিশুপালকে সুদর্শন চক্র করেছিল। মসজিদ হামলার ছকে রাস্তা করছেন। ৩১৯টি মন্দির ভেঙেছেন। কম করে ৪ হাজার পূজারির ভাত কেড়েছেন। বাইরের লোক এনে ভিড় করেছেন। রামমন্দিরে একটা ইট গেঁথেছেন?’
রাত ১১টায় বিশ্বনাথ মন্দির বন্ধ হয়। রাত ১২টা পর্যন্ত গোধুলিয়ায় জমজমাট আড্ডা। এক জায়গায় শুধু যাদবদের। ৪০-৫০ কিলোমিটার দূর থেকে বাইকে ট্যাঙ্ক ঝুলিয়ে দুধ বেচতে আসে। ৭০ থেকে ১০০ টাকা কেজি। দিনরাত চালু। দোকানে দোকানে রাবড়ি, মালাই বিকোচ্ছে। সেই যাদবরা সোচ্চারেই বলছেন, শহরে সব জায়গায় মোদী হারবে। আবার অটোচালক শিউপাল গোঁড় স্পষ্ট বলে দেন, ‘মোদীকে ভোট দেব না।’ সাগরি-লঙ্কা রুটের আরেক অটোচালক বাসুদেব উপাধ্যায় বললেন, ‘রাবণ শিবভক্ত ছিলেন। মোদীও শিবভক্ত। তবে বিকাশের নামে বিনাশ করছেন। বিনাশ মোদীরও হবে।’ এমনই মন্তব্য শোনা যাচ্ছে বারাণসীর আনাচে-কানাচে, অলিতে-গলিতে, ঘাটে-ঘাটে। যা থেকে স্পষ্ট ইঙ্গিত মিলছে, ‘বিকাশ’ নয় এবার ‘বিনাশের’ পথেই চৌকিদার।