শিবপ্রসাদ-নন্দিতা পরিচালকজুটি মানেই অন্যধারার গল্প। অন্য স্বাদের ছবি দেখতে পাবেন বলে ধারণা করেন বাংলার সিনেমাপ্রেমী মানুষের। আর পরিচালক জুটিও গল্পের নতুনত্বের সঙ্গে জনসাধারণের মনোরঞ্জনের কথা ভাবেন। তাঁদের গল্পে তো বটেই চিত্রনাট্যেও সমসাময়িক কিছু নাগরিক সমস্যার সঙ্গে বিনোদনের উপাদান যোগ করে সংখ্যাগুরু দর্শকের আমোদে কোনও ফাঁক রাখতেন না। মধ্যবিত্ত পারিবারিক মূল্যবোধের সঙ্গে নাটক, গান, ঘটনা মিশিয়ে একের পর এক সুস্বাদু ছবি বানিয়ে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু এবার একটু ব্যতিক্রমী ছবি তৈরি করার কথা ভেবে এগিয়েছিলেন। আর তার ফল ‘কন্ঠ’।
গতকাল ‘কন্ঠ’ রিলিজ করেছে। এই ছবির মূল বিষয় হল, একজন রেডিও জকি ও তার জীবন স্রোতের গল্প। একজন রেডিও জকির প্রধান উপাদান তাঁর গলার স্বর। অর্থাৎ কণ্ঠ। সেটাই তাঁর ভালোবাসা, পেশা, নেশা, আবেগ। সেই কণ্ঠস্বর প্রায় আচমকাই কোনও দুরারোগ্য ব্যধির কারণে হারিয়ে গেলে কেমন পরিস্থিতি হয় ব্যক্তিগত মানসিকতায় এবং পারিবারিক জীবনে, সেটাই ‘কণ্ঠ’ ছবির মূল বিষয়। তবে শিবু-নন্দিতা দর্শক বিনোদনের কথা ভেবেই আরজে অর্জুনের সেই সংকট থেকে মুক্তির উপায় দেখিয়ে চিত্রনাট্যে সমাপ্তি টেনেছেন।
ডিপ্রেশনের চরম সীমায় পৌঁছে নিজেকে একটা ঘরের মধ্যে বন্দি করে সে কেবল কথা বলতে না পারার বিকল্প হিসাবে জীবন তাঁকে যে স্লেট আর মার্কার কলম ধরিয়ে দিয়েছে তা দিয়ে লিখতে পারে, ‘একা থাকতে চাই’। কিংবা, ‘লিভ মি অ্যালোন’। তবুও না তার পৃথা না তার দীর্ঘদিনের বন্ধুরা কিংবা রেডিওর সঙ্গীরা তাকে তলিয়ে যেতে দেয়। আর ডুবন্ত মানুষ যে ভাবে খড়কুটো ধরে বাঁচতে চায় অর্জুনও সে ভাবে হাতটা বাড়ায় একদিন। আর সেই হাতটা ধরে নেয় স্পিচ থেরাপিস্ট রোমিলা চৌধুরী অর্থাৎ জয়া এহসান। তাঁরই আন্তরিক শুশ্রূষায় ল্যারিংটোমির রোগী অর্জুন ফিরে পায় স্বর। খাদ্যনালী দিয়ে ইউসোফিক্যাল ভয়েস নিয়ে ফিরে আসে রেডিও স্টেশনে নতুন অনুষ্ঠান করতে। অর্থাৎ দর্শককে ‘সন্তুষ্ট’ রাখার পথটি খোলা রেখেই নন্দিতার চিত্রনাট্য। ল্যারিংজেকটমি নিয়ে এর আগে বাংলায় কোনও সিনেমা হয়নি। কিন্তু এই সিনেমা শুধু সেইসব পেশেন্টেদেরই নয়। অনুপ্রেরণা যোগাবে হাল ছেড়ে না দিয়ে লড়াই চালিয়ে যাওয়া প্রত্যেকটি মানুষকে। আর সেই কারণেই খারাপ লাগে যখন বহুদিনের স্টিরিওটাইপ ভাঙতে না পেরে অর্জুনের স্ত্রী পৃথা শেষমেশ সন্দেহই করে বসে রোমিলাকে।
এবার আসা যাক অভিনয়ে। অর্জুনের চরিত্রে কোনও হ্যাণ্ডসাম নায়ক থাকলে সাধারণ মানুষের অসহায়তা এত অব্যর্থভাবে ফুটত না হয়ত। অভিনেতা শিবপ্রসাদ এবার কিন্তু পরিচালক শিবপ্রসাদকে টেক্কা দিয়েছেন। তাঁর কণ্ঠের জোয়ার আর মিষ্টতার সঙ্গে স্বর হারানোর পর শিবুর অভিব্যক্তি সত্যিই অসাধারণ এবং পরবর্তী সময়ে খাদ্যনালী দিয়ে শব্দ উচ্চারণের কাজগুলো অসাধারণ। পৃথার চরিত্রে পাওলি দাম সংবেদনশীল, সমব্যথী এবং সহধর্মিনী হিসেবে যোগ্য সঙ্গই দিয়েছেন। রোমিলা চরিত্রে জয়া আহসানের উজ্জ্বল-উচ্ছ্বল উপস্থিতি এবং অভিনয় দুটোই স্বাভাবিক। শিবপ্রসাদ তার আটপৌরে উপস্থিতি দিয়েই কণ্ঠকে জীবনের গল্প করে তুলেছে। বেসিনে যখন তাঁর গলা দিয়ে প্রথম রক্ত পড়ে সেই মুহুর্তগুলোয় শিবপ্রসাদের অভিনয় অনবদ্য। এই ছবির গানগুলো ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়। দীপাংশুর লেখা ও সাহানা বাজপেয়ীর গলায় ‘আমার হাঁটু জলে’ গানটি ইতিমধ্যেই জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সব শেষে, শিবপ্রসাদ-নন্দিতা জুটির ছবিতে ব্যতিক্রমী গল্প হলেও তাতে অসহায়তা থেকে বেরিয়ে আসার কথাই বলেছে। যদিও একটু আধুনিকতার সঙ্গে।