বিদ্যাসাগরের জন্মস্থান বীরসিংহ গ্রামের অদূরেই ঘাটাল লোকসভা কেন্দ্র। এইখানে এইবার চতুর্মুখী লড়াই। তবে গত লোকসভা কেন্দ্রে দ্বিতীয় স্থানে শেষ করেছিল সিপিআই। তবে এইবার সিপিআই যাঁকে প্রার্থী হিসেবে দাঁড় করিয়েছে সে একেবারেই আনকোরা। তবে ঘাটাল লোকসভা এলাকা জুড়েই ভোটের মুখে আজ ভেসে বেড়াচ্ছে বিদ্রুপের হাজারো সুর।
ঘাটাল, দাসপুর, কেশপুর, পাশকুড়া, সবং, পিংলা, ডেবরা— একটু পিছন ফিরে তাকালে বাম জমানার ‘ভয়ার্ত’ চেহারার এক ছবি ফুটে ওঠে। শোনা যায়, পঞ্চায়েত ভোটে এক বার এক স্থানীয় যুবক বুক ঠুকে নির্দল হিসেবে মনোনয়ন পেশ করেছিলেন। পরের দিন স্থানীয় সিপিএম নেতা দলবল নিয়ে তাঁর বাড়ির সামনের দাওয়ায় বিশাল লোহার কড়াই রেখে দরজার কড়া নেড়েছিলেন। ওই যুবকের স্ত্রী বেরিয়ে আসতে বিদ্রুপ করে বলেছিলেন, ‘‘দাদা কি মনোনয়ন প্রত্যাহার করবে? নয়তো দাদাকে মেরে এই কড়াইয়ে রান্না করে মাংস আপনাকে খাইয়ে যাব।’’ বলা বাহুল্য, যুবকের আর নির্বাচনে লড়া হয়নি। এইরকম চিত্রে থেকে জায়গা করে নেওয়া কঠিন সিপিআই-এর।
গতবারের লোকসভা নির্বাচনে তৃতীয় স্থানে শেষ করা কংগ্রেস প্রার্থী মানস ভুঁইয়া দল বদলে আজ মেদিনীপুরের তৃণমূল প্রার্থী। সেখানে যাঁকে দাঁড় করিয়েছেন সে অচেনা অনেকেরই।
সেইজন্য এই কেন্দ্রে এইবার চতুর্মুখী লড়াই হলেও মূলত লড়াইটা তৃণমূল ও বিজেপির মধ্যে। কারণ তৃণমূলের প্রার্থী দেব ও বিজেপি প্রার্থী ভারতী ঘোষ। জেলার মাটি কামড়ে পড়ে থাকা বিজেপিরই একাংশ জানাচ্ছেন, প্রার্থী অন্য কেউ হলে হয়তো এক রকম হতো! কিন্তু, ভারতী ঘোষকে তাড়া করে বেড়াচ্ছে তাঁরই অতীত। তিনি মেদিনীপুর জেলার প্রাক্তন পুলিশ সুপার। কেশপুরের যুবকের গলাতে বিদ্রুপের সুর—ওঁর কথাতেই নাকি এক সময়ে বাঘে-গরুতে এক ঘাটে জল খেত! এখন তো দেখছি ওঁকেই সিআইডি জল খাওয়াচ্ছে। কোনানের বাবলু পণ্ডিতের কথায়, ‘২ টাকা কেজি চাল, কন্যাশ্রী-সবুজশ্রীর সুবিধা পেয়েছে গ্রামের মানুষ। শুধু শুধু ঘুরে কেন সময় নষ্ট করছেন ভারতী।’ তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ অভিযোগ, স্থানীয় পুরসভায় কে চেয়ারম্যান হবে, তাও নাকি ঠিক করে দিয়েছেন তিনি। বিদ্রুপ করে এক তৃণমূল নেতা বলেন, ‘সাদা সালোয়ার কুর্তার উপরে বিজেপির পতাকার মতো দেখতে উত্তরীয় গলায় ফেলা থাকলেও, আড়ালে রয়ে গিয়েছে ফেলে আসা খাকি পোশাক। বাবা এখনও কী দাপট!’ তাঁর প্রমাণ আমরা কদিন আগেই পেয়েছি। উত্তরপ্রদেশ থেকে ছেলে এনে কুকুরের মত মারার হুমকি ওনার মুখেই শোনা গেছে।
তবে এত বিদ্রুপের মধ্যে ব্যতিক্রমী হিসেবেএই কেন্দ্রে প্রথম থেকেই এগিয়ে আছে তৃণমূল। কারণ এইখানে তৃণমূল প্রার্থীর নাম যে দীপক অধিকারী-মানুষ যাকে দেব বলে জানেন। পাঁচ বছরে অনেকটাই বদলে ফেলেছেন নিজেকে। গত বার ছিলেন শুধুই অভিনেতা। এ বার সঙ্গে নেতাও হয়ে উঠেছেন অনেকটা। কথা বলছেন অকপট। তাঁর কথায়, ‘কী ভাবে এত তাড়াতাড়ি পাঁচটা বছর কেটে গেল বুঝতে পারলাম না।’
আর দশটা রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীর পথে হাঁটতে চান না তিনি। অমায়িক শোনায় তাঁকে, ‘গত পাঁচ বছরে ঘাটাল মাস্টার প্ল্যান নিয়ে, বন্যার সময়ে মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করেছি। কতটা পেরেছি জানি না। যতটা পারিনি, তার দায়ভার একার আমার। আর কারও না। উন্নয়নই এইবার শেষ কথা হবে নির্বাচনে।’ জানিয়েছেন যে তাঁকে দেখে নুসরত-মিমিরা ভোটে লড়ার সাহস পেয়েছেন-এটা দেখে তাঁর ভাল লেগেছে।
বিরোধীদের সম্পর্কেও তিনি অমায়িক। তাঁর কথায়, ‘বিরোধীদের নামে কুৎসা করা হয় বলেই বোধহয় রাজনীতি নিয়ে সাধারণ মানুষ আজ বীতশ্রদ্ধ।’ তাই, কাউকে আক্রমণের পথে হাঁটতে চান না। এইভাবে রাজনৈতিক মঞ্চে থেকেও কাদা ছোঁড়াছুঁড়ির থেকে নিজেকে বিরত রেখেছেন। হয়ে উঠেছেন ব্যতিক্রমী।