গ্রামের নাম লক্ষ্মীপুর। শুনে অনেকের মনেই এই প্রশ্ন জাগবে যে এ আবার কোথায়? সেটাই স্বাভাবিক যদিও। কারণ ভারতবর্ষের শেষ গ্রাম লক্ষ্মীপুর যেন এক বিচ্ছিন্ন দ্বীপ। আর এখানকার অধিবাসীরা ‘নিজ ভূমে পরবাসী’। কেন? আসলে স্বাধীন দেশে বসবাস করলেও গ্রামবাসীরা ইচ্ছে মতো গ্রামে ঢুকতেও পারেন না, আবার বের হতেও পারেন না। সময়সূচি বেঁধে দেওয়ায় দিনের নির্দিষ্ট সময়েই তাঁদের যাতায়াত করতে হয় তাঁদের। শুধু ভোটের সময় নয়, এই গ্রামে প্রবেশ করতে গেলে অথবা গ্রাম থেকে বের হলে এখানে সারাবছরই ভোটার কার্ড লাগে। গ্রামের তিনদিকে বাংলাদেশ সীমান্ত। কোনও কাঁটাতারের বেড়া নেই। তাই বিদেশ না হলেও ভোটার কার্ডই হল এই গ্রামে ঢোকার অলিখিত ‘পাসপোর্ট’।
বয়রা গ্রাম থেকে সরু কপোতাক্ষ নদীর সাঁকো পার হলেই লক্ষ্মীপুর গ্রামে ঢোকার বড় গেট! দোকান খোলার মতো এই গ্রামের গেট খোলা হয় সকাল ৬টায়। আবার বন্ধ করা হয় বিকাল ৫টায়। তারপর ইমারজেন্সি ছাড়া কোনও গ্রামবাসী গ্রামে ঢুকতেও পারেন না, বের হতেও পারেন না। গেটের মুখেই বিএসএফের পোস্ট। সেখানেই গ্রামবাসীদের ভোটার কার্ড পরীক্ষা করেন জওয়ানরা। এই গ্রামে প্রায় ৭৫টি পবিরারের বসবাস। জনসংখ্যা প্রায় ৪০০। সোমবার ছিল বনগাঁ লোকসভার ভোট। এই গ্রামে বুথ হয়নি। পাশেই বয়রা গ্রামে বুথ করা হয়েছিল। লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দারা পায়ে হেঁটে সেখানেই ভোট দিতে যান।
তবে, মজার কথা হল, যাঁরা ভোট দিতে যাচ্ছেন, তাঁদের অনেকেই ‘দিদি’কেই প্রার্থী বলে জানেন। অষ্টমী শিকদার নামে এক বৃদ্ধা যেমন বলেন, আমাদের গ্রামের প্রার্থী তো মমতা! সুমন বিশ্বাস নামে এক যুবক বলেন, আমাদের নিজের গ্রামে ঢুকতে গেলে ভোটার কার্ড দেখিয়ে ঢুকতে হয়। আবার বয়রা গ্রামের দু’জন চাষি মহাদেব বাছার ও তপন দাস বলেন, আমাদের চাষের জমি আছে লক্ষ্মীপুর গ্রামে। জমিতে চাষ করতে যাওয়ার সময় ভোটার কার্ড জমা দিয়ে যাই। ফেরার সময় ভোটার কার্ড নিয়ে যাই। ভারতের মধ্যেই এই নিয়ম।
বিএসএফের ওই পোস্টে ইন্সপেক্টর অনিরুদ্ধ কুমার বলেন, দেখুন নিরাপত্তার স্বার্থে এই নিয়ম চালু রয়েছে। সবার পরিচয়পত্র দেখা হয়। কারণ, এই গ্রামের তিন পাশেই বাংলাদেশের সীমান্ত। মাঝখানে কোনও বেড়া নেই। এই গ্রামের সীমানা সত্যিই অন্যরকম। আবার লক্ষ্মীপুর লাগোয়া বয়রা গ্রামে প্রবেশ কিংবা বের হওয়ার কোনও নিয়ম নেই। কোনও ভোটার কার্ডও লাগে না। কিন্তু, এই গ্রামের সীমান্ত খুবই অদ্ভুত। বলাই বিশ্বাসের বাড়ির উঠানে ফুট দেড়েক উচ্চতার একটি সিমেন্টের ‘টি-পিলার’ বসানো। তার একদিকে লেখা—‘বাংলা’ অর্থাৎ বাংলাদেশ, অন্যদিকে, লেখা-ইন্ডিয়া।
তাঁর বাড়ির উঠোনের পাশেই একটি দড়ি টাঙানো। সেখানে রোদ্দুরে জামাকাপড় শুকোচ্ছে। বাড়ির সামনে বসে বলাই বলেন, আমরা বাড়ি ভারতে। কিন্তু, উঠোনের পাশে যে দড়িতে জামাকাপড় শুকোচ্ছে ওটা বাংলাদেশ। কিছুটা দূরেই ৬৫ বছরের বৃদ্ধা রীতা হালদারের বাড়ি। তাঁর বাড়ির পিছনেও লোহার টি-পিলার। তিনি বলেন, আমরা তো ভারতের বাসিন্দা। কিন্তু, পা ফেলার জায়গা নেই। আমরা বাড়ি থেকে তিনফুট দূরেই বাংলাদেশের সীমানা। তাঁর কথায়, ‘বৃষ্টি হলে আমার টিনের ছাউনির জল বাংলাদেশে গিয়ে পড়ে।’