মানুষের মমতা

খবরের কাগজে যোগ দেওয়ার আগে থেকেই এদের সঙ্গে আমার দেখা হত। চিত্রসাংবাদিকতা শুরু করার পর তা আরও বাড়তে থাকে। নানা সময়ে, নানা পরিস্থিতিতে নানাভাবে আমি এদের দেখে চলেছি। কর্মসূত্রে নির্বাচনী সফরে ঘোরার সময়েও এদের সঙ্গে আমার রোজ দেখা হয়। নির্বাচনী উত্তাপ এদের স্পর্শ করেনা, এদের কাছে তা শুধু অবাক হওয়ার ব্যাপার! অবাক বিস্ময়ে তারা শুধু যেন জানতে চায়, আমাদের কথা কিছু ভাবছো? এই না বলা কথাটাই ভারত নামক রাষ্ট্রটিকে একটা প্রশ্নের সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। আমার কাছে এই প্রশ্নের কোন উত্তর নেই। দেশের দেখভালের দায়দায়িত্ব যারা নিয়ে নিয়েছেন তাদের কাছেও নেই। থাকলে আমার সঙ্গে ম্লান, হতভম্ব, ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, বস্ত্রহীন, শীর্ণকায় এই শিশুগুলির দেখা হত না। পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম গণতন্ত্রের ব্যর্থতা শৈশবের এই হাল করে ছেড়েছে।
ভোট নেই তাই নির্বাচনী লড়াইয়ে এদের কোন কদর নেই। ভোটের বাজারে কখনও কখনও দুর্গম গ্রামে কিংবা জনসভার কাছাকাছি এলাকার বস্তিতে অথবা পদযাত্রার ভিড়ে মায়ের কোলে বা পাশে থাকার সময়ে কোন প্রার্থী এদের গাল টিপে আদর করেন, জিজ্ঞেস করেন নাম, মায়ের মুখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে। সারাজীবন তিনি এই গাল টিপে আদর করার গল্প বলে চলেন। শিশুটির বেঁচে থাকাটা কিন্তু বদলায় না। আমাদের সংবিধান কাগজে কলমে শিশুদের অধিকারের স্বীকৃতি দিয়েছে। তার সামান্য কিছুও যদি রূপায়িত হত তাহলে এই শিশুগুলির পরনে থাকতো পোশাক, শরীরে থাকতো স্বাস্থ্য, চোখে থাকতো সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন।

দেশের মহান রাষ্ট্রনায়কদের অনেকেই এদের কথা ভেবেছেন, সংখ্যায় কম হলেও অনেকেই এখনও এদের কথা ভাবেন। যোজনায় এদের উন্নয়নের জন্য অর্থের সংস্থানও আছে। আমি জানি, এরপর আপনারা বলবেন সবই আছে কিন্তু পরিকল্পনার অভাবে কিছু হচ্ছে না। আমি বলছি না তাও আছে, কিন্তু সবকিছু খেয়ে নিচ্ছে যারা এই সুবিধাগুলি একেবারে পিছিয়ে থাকা মানুষদের কাছে পৌঁছে দেবেন তাদের সদিচ্ছার অভাব এবং ব্যাপক জোচ্চুরি। এর পাশাপাশি রয়েছে মাটির কাছাকাছি পৌঁছনোর মত বিজ্ঞানসম্মত পরিকল্পনার ব্যর্থতা। অথচ গ্রামগঞ্জে ঘুরতে ঘুরতে এও দেখছি ইদানিং এ রাজ্যে যারা একটু স্কুলে যাওয়া, মিড ডে মিলের সুযোগ কিংবা নিখরচায় স্বাস্থ্য পরিষেবা পাওয়ার সুযোগ পেয়েছে তাদের জীবনের চাকাটা কত দ্রুত ঘুরতে শুরু করেছে। স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় এদের বেড়ে ওঠার যে পরিসর তৈরি হয়েছে তা অনেক শিশুরই বৃদ্ধির পথ প্রশস্ত করেছে।

আমরা কেউই শিশু ভোলানাথদের এই অবস্থায় দেখতে চাইনা। শিশুরাই আগামি দিনের নাগরিক, রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ। তাদেরকে অবহেলিত রেখে কোন দেশই এগোয় না। এটা একটা সাধারণ সত্য। তাদেরকে ঘিরেই সব পরিকল্পনা হওয়া উচিৎ। কিন্তু তা যতটা প্রয়োজন তা না হওয়ার ফলে সমস্যা বাড়তে বাড়তে একটা জটিল চেহারা নিয়েছে। মাঝে মাঝে চোখ বুজলে দেখতে পাই একটা বিস্তীর্ণ মাঠের ওপর দিয়ে হেঁটে আসছে নিরন্ন, উলঙ্গ শিশুদের বিশাল মিছিল। নীরবতাই সেই মিছিলের ভাষা। রাষ্ট্র কামান,বন্দুক নিয়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়তে পারলেও এই মিছিলের সামনে অসহায়। যুদ্ধ করা তো দূরের কথা, এদের চোখের দিকে চোখ রেখে কথা বলার সাহসও সে হারিয়েছে। আমি কাউকে দোষারোপ করছি না। আসুন আমরা সবাই মিলে যে যার ক্ষমতা অনুযায়ী এই মিছিলটাকে অদৃশ্য করে দেওয়ার কাজে নামি। নিজের এলাকায়� ছোটদের ভালোর জন্য নিজেদের মত করে কিছু কাজ করি।
বিশ্বাস করুন,এমন ছবি আমার আর তুলতে ইচ্ছে করে না। গরিবীর ছবি তোলার মত কোন শিশু পাওয়া যাচ্ছে না এমন একটা দিনের অপেক্ষায় রইলাম।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত