রবিবার সন্ধ্যা প্রায় সাতটা নাগাদ একটি গাড়িতে চেপে ৮ জন পর্যটক সিকিমের বাবা মন্দির থেকে গ্যাংটকের দিকে ফিরছিলেন। সেই সময় সিকিমের নাথুলার কাছে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ৪০০ মিটার নিচে খাদে গড়িয়ে পড়ে। ঘটনাস্থলেই চারজন পর্যটকের মৃত্যু হয়। বাকিদের উদ্ধার করে দ্রুত মণিপাল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সেখানে একজন পর্যটক মারা যান। তবে সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা হল, খাদে উদ্ধার হওয়া এক মৃত মহিলার কোলে তাঁর বছর পাঁচেকের শিশুপুত্রকে আটকে থাকতে দেখা যায়। ভাগ্যক্রমে যে বেঁচে গিয়েছে।
প্রসঙ্গত, সিকিমের সাত মাইলে খাদের ধারে তখন বেশ অন্ধকার। তার মধ্যেই খাদে কিছুটা নেমে উদ্ধারের কাজ চালাচ্ছিলেন স্থানীয় মানুষরা। সঙ্গে পুলিশ ও বিপর্যয় মোকাবিলা দল। তাঁদেরই এক জন প্রথম দেখতে পান, মায়ের কোলে আটকে আছে বছর পাঁচেকের শিশুপুত্র। তখনও বোঝা যায়নি, সে বেঁচে আছে কিনা। উদ্ধার করে সব ক’জনকেই হাসপাতালে পাঠানো হয়। গুরুতর চোট পেলেও শিশুটি বেঁচে গিয়েছে। কিন্তু রবিবার সন্ধ্যায় ছাঙ্গু থেকে গ্যাংটকে ফেরার পথে সেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু হয়েছে শিশু সূর্যাশিসের বাবা-মা সন্দীপ কর (৪৫), সোমা করের (৩২)। সঙ্গী কাকলি বসু (৫২), স্নেহাশিস বসু (৫৭) ও শুভজিৎ বসুও (২৬) মারা গিয়েছেন। শিশুটি ছাড়াও বেঁচে গিয়েছেন আর এক যাত্রী মহুয়া পাত্র।
পুলিশ সূত্রে খবর, দুর্ঘটনা হতে চলেছে বুঝে গাড়ি থেকে শেষ মুহূর্তে ঝাঁপ দিয়ে প্রাণে বেঁচে যান চালকও। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে সোমবারই গ্যাংটকে পৌঁছেছেন সন্দীপের বাবা আশিস কর। তিনি জানান, দুই পরিবারের সদস্যরা গত ২৬ এপ্রিল কলকাতা থেকে বেরিয়েছিলেন। সন্দীপ ও তাঁর স্ত্রী সোমার সঙ্গে ছিল সোমার মামা স্নেহাশিস বসু, মামি কাকলি বসু, মামাতো ভাই শুভজিৎ বসু এবং ভাইয়ের স্ত্রী মহুয়া পাত্র। রবিবার ছাঙ্গু ঘুরে তাদের সোমবারই কলকাতার রওনা হওয়ার কথা ছিল।
জানা গেছে, প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি হয়ে বাবা-মায়ের সঙ্গে বেড়াতে এসেছিল সূর্যাশিস। গাড়ি খাদে পড়ে যাওয়ার সময়ে সে মায়ের কোলেই ছিল। বাকিরা গাড়ি থেকে বাইরে ছিটকে পড়ে। কিন্তু ছেলে কোলে সোমা গাড়িতে আটকেছিলেন। দুর্ঘটনার অভিঘাতে সূর্যাশিস জ্ঞান হারিয়েছিল। গ্যাংটকের এসটিএনএম হাসপাতাল সূত্রে জানা গিয়েছে, তার বাঁ গালে চোট রয়েছে। সে দিকটা ফুলে আছে। ছড়ে গিয়েছে ডান পায়ের গোড়ালিও। আশিসবাবুকে সে জানিয়েছে, গাড়ি পড়ে যাওয়ার সময়ে মা তাকে শক্ত করে কোলের মধ্যে চেপে ধরেছিলেন।
কিন্তু দুর্ঘটনা কীভাবে ঘটল? পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, রবিবার ছাঙ্গু লেক থেকে গ্যাংটকে ফিরতে দেরি হয়ে গিয়েছিল সন্দীপদের। রাস্তার কিছু অংশে বরফ থাকায় তা এখনও পিছল। এরই মধ্যে সন্ধ্যা হয়ে আসে। নেমে আসে ঘন কুয়াশাও। এই অবস্থায় বাঁকের মুখে রাস্তা দেখতে না পেয়ে গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে খাদে পড়ে যায় বলেই পুলিশের প্রাথমিক সন্দেহ। পূর্ব সিকিমের এসপি হেমরাজ রাই বলেন, ‘কুয়াশার জন্যই গাড়িটি নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছিল বলে প্রাথমিকভাবে জানা গিয়েছে। তবে একটি মামলা রুজু করে তদন্ত শুরু হয়েছে।’
এখানে প্রশ্ন উঠেছে, যেখানে ছাঙ্গু ঘুরে বিকেলের একটি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে গ্যাংটকে ফেরার নিয়ম রয়েছে, সেখানে এত দেরি হল কেন? এবারে শীতের মরসুমেও দু’দিন ছাঙ্গুতে বরফের মধ্যে আটকে যান বেশ কয়েক শো পর্যটক। তখন সেনারা এসে তাঁদের উদ্ধার করে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করেন। ওয়াকিবহাল অনেকেই বলছেন, দুপুরের পর থেকে পাহাড়ি আবহাওয়ার খামখেয়ালিপনা শুরু হয়। তাই ফেরার সময় বেঁধে দেওয়া রয়েছে। এই নিয়ম যে মানা হচ্ছে না, সে ব্যাপারে নজরদারিও কম বলে অভিযোগ।