মানুষের মমতা
কর্মসূত্রে বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নির্বাচনী সফর কভার করছি গত তেসরা এপ্রিল থেকে। জনসভা আর পদযাত্রার ধকলে এখন আমাদের কারও নাওয়া খাওয়ার ফুরসৎ নেই। গতকাল রাত দশটা নাগাদ টিভি খুলতেই দেখলাম মোদি এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, দিদি তো আমাকে কুর্তা আর মিষ্টি পাঠান। আপাতদৃষ্টিতে খুব নিরীহ মন্তব্য, একজন রাজনীতিবিদকে আরেকজন রাজনীতিবিদ কোন উপহার পাঠাতেই পারেন কিন্তু আমার মনে হয় মোদির ছোড়া এই বলটাতে একটা ইনস্যুইং আছে। বক্তা হয়তো এর মধ্যে দিয়ে বলতে চাইছেন, বাইরে কুস্তি থাকলেও ভিতরে ভিতরে আমাদের দোস্তি যাকে বলে একেবারে জমজমাট। মোদির ইন্টারভিউয়ের মতই এটা যেন একটা শুটিং শুটিং ব্যাপার! ধর্মীয় ফ্যাসিবাদের সঙ্গে গণতন্ত্রের যে লড়াই এবারের ভোটে হচ্ছে; দেশজোড়া যে সংগ্রামের অন্যতম প্রধান মুখ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সেই সংগ্রামকে যেন এই মন্তব্যের মধ্যে দিয়ে কিঞ্চিৎ লঘু করে দেওয়ার চেষ্টা করা হল। অন্যরা কে কী ভাবছেন আমি জানিনা, আমার এমন মনে হচ্ছে তাই এই প্রসঙ্গের অবতারণা।

সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের রাজনীতিতে অভিষেক। লড়াইয়ের ময়দানে তাকে বারবার পুলিশের বর্বর আক্রমণ, সিপিএম গুণ্ডাদের নৃশংস হামলা, লাগাতার কুৎসা ও ব্যক্তিগত আক্রমণের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে। তবুও তার রাজনৈতিক সৌজন্যবোধ ও ভদ্রতা এতটুকু টাল খায়নি। জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবু, সোমনাথবাবুরা তাকে বারবার কটু কথা বলেছেন, অসন্মান করেছেন, চুলের মুঠি ধরে মহাকরণ থেকে তাকে বার করে দিয়েছিল পুলিশ, জ্যোতিবাবু, বুদ্ধবাবুরা তাকে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব বলে মনেই করতেন না, সেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় কিন্তু তাদের অসৌজন্যের জবাবে পাল্টা কোন অসৌজন্য দেখাননি। ক্ষমতা থেকে চলে যাওয়ার পর জ্যোতিবাবুর জন্মদিনে বাড়ি গিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন, অসুস্থ বুদ্ধবাবুর সঙ্গে বাড়িতে গিয়ে দেখা করে তার শারীরিক অবস্থার খোঁজখবর নিয়েছেন, বলেছেন যে কোন প্রয়োজনে তার সঙ্গে যোগাযোগ করার কথা। এটাই স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ, মোদি-অমিত মার্কা রাজনীতিবিদদের কল্যাণে আজকের রাজনীতি থেকে যা প্রায় অদৃশ্য হয়ে গেছে। এই সৌজন্যবোধ আছে বলেই দিদি এটা করতে পারেন কারণ তার কাছে এটাই স্বাভাবিক। মোদি এটা করতে পারেন না বলে এটা তার কাছে নিছকই একটা রাজনীতির খোরাক।
জ্যোতিবাবু কিংবা বুদ্ধবাবুর বাড়িতে যাওয়ার সময় তার সঙ্গে কোন মিডিয়াবাহিনী ছিলনা, কাউকেই তিনি কিছু জানাননি। তিনি গিয়েছেন নিজের কর্তব্যের তাগিদে। এসব কোন পাবলিসিটি স্টান্ট ছিলনা। বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদদের প্রতি তার বিনয় ও সন্মান জানানোর অভ্যাসই দিদিকে টেনে নিয়ে গেছে তাদের বাড়িতে। বাংলার যে মুখ্যমন্ত্রী এখনও তার শরীরে বাম আমলের পুলিশ ও গুণ্ডাদের আক্রমণের ক্ষতচিহ্ন নিয়ে ঘোরেন তার এত সহনশীলতা আর সৌজন্য আসে কোথা থেকে? দিদি বলেন, সৌজন্য আর ভদ্রতা ছাড়া রাজনীতি হয়না। এই শিক্ষার পটভূমিতে থাকে পরিবার। সত্যিই তাই, আমরা সবাই পরিবার থেকেই এই শিক্ষা পাই। যারা পান না তারা হয়ে ওঠেন কুটিল, ক্ষমতালোভী ও হিংসাত্মক। আচ্ছা আপনারা বলুন তো যারা নিজের স্ত্রী, পরিবারকে সন্মান করেননা, নিজের রাজনৈতিক গুরু ও পথপ্রদর্শকদের দূরে সরিয়ে দেন তারা কী করে অন্যদের সন্মান করবেন!
রাজনীতি মানেই বিরোধ, দল থাকলেই দলাদলিও থাকবে। তবে তা সাধারণ ভদ্রতার সীমারেখা অতিক্রম করলে আমার ব্যক্তিগতভাবে খুব খারাপ লাগে। এবারের ভোটে দেখছি ব্যক্তিগত কুৎসার বন্যা বইছে। রাজনীতির সঙ্গে কোন যোগ নেই পরিবারের এমন কোন সদস্যের প্রতিও বিরোধী নেতারা কুৎসিত মন্তব্য করছেন। কারও রাজনীতি ও কাজকে ছোট এবং ভুল প্রতিপন্ন করার জন্য আক্রমণ করা হচ্ছে তার পরিবারকে। ভোট মিটে যাবে, কেউ জিতবেন কেউ হারবেন কিন্তু যে মিথ্যাকথাগুলো নেতারা বললেন পরে তার টেপ বাজিয়ে তাদের শোনানো হলে তারা নিজেরাই লজ্জা পাবেন।
অবশ্য মোদির মত রাজনীতিবিদদের লজ্জা বলে কিছু নেই। যেভাবে বাজপেয়ী-আদবানি-যোশীদের তিনি অপমান করলেন তার জন্য দেশবাসী দুঃখ পেলেও তার কোন লজ্জা হয়নি। এর ফল মোদি-অমিতরা পাবেনই কারণ খারাপ জিনিস ওপর থেকে নিচে নামে। দিন ফুরোলে গদা ও তলোয়ারধারী সেবকরা তাদের সঙ্গে এমন আচরণই করবে। যে অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে সিপিএম এখন যাচ্ছে। তাদের পক্ককেশ ও বৃদ্ধ নেতাদের দলের তরুণরা একেবারেই পাত্তা দেয় না। কান পাতলেই শুনবেন – …বাবু কিছুই বোঝেন না, বয়স হয়েছে তো!
বয়স সবার হবে ভাই, সবাই তাদের কৃতকর্মের ফল ফেরৎ পাবেন। তাই বলি, সৌজন্যবোধ, ভদ্রতার সঙ্গে রাজনীতির কোন বিরোধ নেই। আমাদের দিদিকে যারা অপমান করেছিলেন স্বাভাবিক সৌজন্যবোধ দিয়েই তিনি তার জবাব দিয়েছেন। কালীঘাটের অগ্নিকন্যা বলে একদা যারা তাকে উপহাস করতেন তারাই দেখছেন সেই মেয়েটি গোটা দেশের রাজনীতির এক অন্যতম চালিকাশক্তি হয়ে উঠেছেন। নিজেদের ব্র্যান্ড ভ্যালু বাড়াতে মোদিকে তার কাছ থেকে পাওয়া উপহারের কথা বলতে হচ্ছে। জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের মত উচ্চতায় মোদিরা কোনদিনই পৌঁছতে পারবেন না। কারণ, মানুষ মনে রাখে ভাল উদাহরণ। আমাদের দিদি তার জীবন ও কাজ দিয়ে সেই দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন।
অকৃত্রিম এই সৌজন্যই জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমর্থনের ভিত আরও মজবুত করেছে। আগামী ২৩মে মোদিবাবুরা দিদির সৌজন্যের রাজনীতির শক্তি বুঝতে পারবেন।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত