ফিরিছে, ফিরিছে, ফিরিছে। টিকটক আবার ফিরিতেছে স্বমহিমায়। মাদ্রাস হাইকোর্ট এর মাদুরাই বেঞ্চ ব্যান উঠিয়ে দিলো। সাথে এও বললো যে ব্যাপকভাবে ব্যবস্থা যেন নেওয়া হয় কোন ধরনের যৌন, নগ্ন বা child pornographic ভিডিও দেখলেই। মানে আবার টিকটক ডাউনলোড করা যাবে।
আবার আপনার জীবনে চরম আনন্দ বা ঝাঁট জ্বালানোর কারণ হয়ে ফিরে আসবে এই চীনে সাইট। আবার দুপুরবেলা নাইটির ওপরে গামছা গায়ে ‘গাঁয়ের বধূ’ ক্যাটরিনা কাইফের গানে গলা মেলাবে। পাড়ার বান্টুদা যে ‘তেরে নাম’ ছাঁট করে চুলে, সে আবার সলমান খানের মতো রেগে যাবে বা বউ এর সাথে ঝগড়া করে কাঁদবে ক্যামেরা চালিয়ে আর লোকে লোকান্তরে সে ভিডিও প্রচারিত হবে। এ সবকিছুই হবে কারণ টিকটক কেবল একটি ভিডিও আপ্লিকেশন নয়। এটি ওয়েবদুনিয়ার বৃহত্তম সমাজতন্ত্র যেখানে সত্যিই আমরা সবাই রাজা আমাদের এই রাজার রাজ্যত্বে।
সাধারণ মানুষ যে “কাহারবা নয় দাদরা বাজাও উল্টো পাল্টা মারছ চাঁটি” গানটা সঠিক সুরে গাইতে পারে না, সে কী গোটা জীবন গান গাইতে ইচ্ছে করলে ও প্রজার মতো গান শুনেই কাটাবে? ওয়েব দুনিয়ার গনতান্ত্রিক পরিমন্ডলে ওসব সামন্তবাদ চলে না। হিসব স্পষ্ট। কেউ সারাজীবন গেয়ে যাবে আর কেউ সারা জীবন শুনে যাবে তা কী করে হয়। সে বেছে নেবে “ওয়াই দিস কোলাবারি ডি’ বা ‘বারান্দায় রোদ্দুর’৷ হুলিয়ে জনপ্রিয় হবে ওই গান৷ ক্যান্টিনে কমোডে যে যখন পারবে গাইবে৷ ওটা তখন স্রেফ গান না, তার সাধারণত্ব উদযাপন।
এটা সাধারণত্ব উদযাপনই তো হচ্ছে গোটা বিশ্বজুড়ে। এটা ও মেনে নিতে হবে। এলিটিস্ট নাক উঁচুপনা করলে নিজেকেই নিজে কষ্ট দেবে। কারণ গনতন্ত্র বিরোধীদের ও হয়। আর হয় প্রান্তিক, পেটরোগা, প্রোলেতারিতের। সে যদি শনিপুজোয় টুনির মা চালায় আর তারপর ট্রেড ইউনিয়ন নেতা মারা গেলে একই আবেগে ‘গাও ইন্টারন্যাশনাল’ এ গলা মেলায়, দুটোই মেনে নিতে হবে কারণ আপনার উৎকৃষ্টতর শিল্পকর্মগুলো হিটলারকে না রবীন্দ্রনাথকে হাইলাইট করে এসেছে। আপনার তথাকথিত কালজয়ী সাহিত্যেগুলো কদাকার বড়লোক না ময়লা কালো সাধারণ মানুষদের জয়গান নিয়ে৷ এবার এই হাগড়ে হাবাতে মানুষেরা যদি অপরিসীম ক্ষমতা পেয়ে যায়? তখন যা হবার ঠিক তাই হচ্ছে টিকটকে।
অমলকান্তি যে রোদ্দুর হতে চেয়েছিল আর শ্যামলী যে মাধুরী দীক্ষিত হতে, তাদের দুজনেরই হাতে এখন অত্যাধুনিক স্মার্ট ফোন আর ফোরজি ইন্টারনেট। নিজের সৃজনশীলতা প্রকাশ করতে আর দরজায় দরজায় ঘুরতে হয় না এদের। ঘরে বসে ভিডিও রেকর্ড করো আর ভাইরাল হয়ে যাও।
এবার এই ভাইরাল হতে গেলে হয় তোমাকে ভয়ানক উৎকৃষ্ট বা ভয়াবহ নিকৃষ্ট কিছু করতে হবে। মানে এ.আর. রহমান বা রোদ্দুর রায় কিংবা নাসিরুদ্দিন শাহ বা হিরো আলম। মাঝামাঝি থাকলে তুমি ফাউ৷ বদলে যাওয়া পৃথিবীতে রাজপ্রাসাদের লেখকের চেয়ে ফেসবুকের ব্লগারের কদর দ্বিগুণ।
টিকটক নিয়ে অনেক মানুষের অনেক সমস্যা। খোঁজ নিয়ে দেখবেন এরা সৃজিতের ছবি দেখলে ও বিব্রত হয় কিন্তু নিয়ম করে সবকটা ছবি দেখতে যায়। এরা শ্রীজাতকে বলে মধ্যমেধার ছড়াকার কিন্তু ওর সবকটা গানের লাইন মুখস্থ। আসলে ওটা পক্ষ না নিতে পারার অসহায়তা৷ আমি সাধারণ মধ্যমেধার মানুষ – আমি সারাজীবন শ্রোতা বা দর্শক হয়ে থাকবো না আমিও আলটপকা কিছু করে সুপারস্টার হবো আমার মহলে৷ আর এই অসহায় অবস্থাটাই ঝাঁট জ্বালানো মনে হয়।
যে মেয়েটা আলুথালু বেশে রোজ একটা করে ভিডিও দেয় টিকটকে তার যদি এটা করে আনন্দ হয়, কার আপত্তি? আপনি দেখবেন না মশাই। সেই সময় ভালো একটা বই পড়ুন বা নেটফ্লিক্সে সিনেমা দেখুন। আপনার বা ওর কারো মাথাতেই তো কেউ বন্দুক ঠেকিয়ে বলে নেই বই পড়তেই হবে বা টিকটক দেখতেই হবে।
ভীষণরকম সাধারণ মানুষ আর অসম্ভব ক্ষমতাশালী, জনপ্রিয় মানুষের মাঝের দেওয়ালটা যদি গুড়িয়ে দেওয়া হয় আর প্রতিভা দেখাবার জায়গাটা হয়ে যায় সমান তখন সেটাকে বিপ্লব বলে। আপনার সৌখিন ড্রইংরুমে তা নিয়ে বিশাল আলোচনা হোক বা না হোক, ওটা কে ও সহ্য করতে শিখুন।
১৭টা যদি হিরো আলমের ভিডিও ভাইরাল হয়, দুটো মিরচি সোমক আর অগ্নির ও ভিডিও ভাইরাল হয় আর একটা কোন বোরখা পরা সিক্রেট সুপারস্টারের যাকে অনেকগুলো আগল ভেঙে ক্যামেরার সামনে বসতে হয়েছিল।
পৃথিবীর যা কিছু কুক্ষিগত করা আছে, তা হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে এলে ভালোই লাগে। ঘুমন্ত ফ্যাসিস্ট চিন্তাকে ফিনফিনে ধুতি, বৌদ্ধিক জ্যাঠামো বা বিবেকের টুইস্ট যতই দিই না কেন, শেষমেশ আমরা ওই ‘গণ’তেই গিয়ে ঠেকি।
সাধারণ মানুষকেই ঠিক করতে দিন ওরা ল্যাজে কাটবে না মুড়োয়। আলগোছে anarchy হবে, দু পা এগিয়ে চার পা পিছোবে কিন্তু ছোট্ট ছোট্ট পায়ে চলতে চলতে ঠিক পৌঁছে যাবে দিনবদলের দোরগোড়ায়। গণ এন্টারটেনমেন্টের সবচেয়ে সাধারণ স্টারের বিপুল হিট ডায়লগ ধার করে বলি, Don’t underestimate the Power of a Common Man! ইয়ে মানে ওই গণ যা কিছু আর কি! কখন বেদের মেয়ে জ্যোৎস্না বানাবে আর কখন থ্রি ইডিয়েটস floating voterদের মতি গতি বোঝার মতো ভান করবেন, বুঝতে পারবেন না।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত