গত ১১ এপ্রিল থেকে গোটা দেশ জুড়ে শুরু হয়েছে লোকসভা নির্বাচন। ৭ দফা ভোটের মধ্যে ইতিমধ্যেই অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে দু’দফার ভোট। আগামী ২৩ এপ্রিল তৃতীয় দফার ভোট। এই তৃতীয় দফাতেই ভোটগ্রহণ হবে বাংলার ৫ কেন্দ্রে। যার মধ্যে রয়েছে জঙ্গীপুরে। গতবার এই কেন্দ্রে জয়ী হয়েছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ও প্রাক্তন অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের পুত্র তথা কংগ্রেস সাংসদ অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়। তবে এইবার হাওয়া তার বিপক্ষেই।
হলধর মণ্ডল, বাড়ি খড়গ্রামে। দ্বারকা নদী পেরিয়ে মুড়ির ২-৩টি বড় বস্তা হাতে টানা ভ্যানে চাপিয়ে বিক্রি করেন গাঁয়ে গাঁয়ে। আপাদমস্তক কংগ্রেসি। দাদু, বাবার মতো হলধরও ভোট দেন কংগ্রেসকে। প্রণববাবুকে দিয়েছেন। তাঁর পুত্র অভিজিৎকে দু’বার দিয়েছেন। কিন্তু জঙ্গীপুর লোকসভার গ্রামের এই ভোটারটি এবার ভাবছেন কাকে ভোট দেবেন। হলধরের মতো এমন কংগ্রেসির সংখ্যা বহু। এরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন জঙ্গীপুরের ৭ বিধানসভার গ্রামে গ্রামে। তৃণমূল হলধরের মতো কংগ্রেসিদের ‘ভাবনা’কে হাতিয়ার করে এগোচ্ছ। এবং এলাকার প্রত্যন্ত গ্রামে এর একটা ছায়াও পড়ছে।
জঙ্গীপুর কেন্দ্রের একদিকে লাখ লাখ বিড়ি শ্রমিকের বসবাস। অন্যদিকে নবগ্রাম, সাগরদিঘি, খড়গ্রামের মতো রাঢ় এলাকার রুক্ষ মাটি। যে মাটি বরাবর ছিল সিপিএমের। মাঝে মাঝে কংগ্রেসের। সেই রুক্ষ মাটিতে এখন জোড়া ফুলের রমরমা। এককথায় একটি লোকসভায় দু’ধরনের রাজনৈতিক মাটি, তার মানুষদের জীবনচর্চা, সবকিছু আলাদা। ভোটেও তার প্রভাব পড়ে। এবারও পড়ছে। ২০০৪-র আগে জঙ্গীপুর ছিল সিপিএমের। কিন্তু প্রণব মুখোপাধ্যায় প্রার্থী হওয়ার পর থেকে এখনও পর্যন্ত তা কংগ্রেসের। প্রণববাবু রাষ্ট্রপতি হওয়ার পর ছেলে অভিজিৎ দু’বার।
কিন্তু কথা হল, ২০১৪-তে ফারাক ছিল মাত্র ৮ হাজার ১৪১ ভোটের। সেবার তৃণমূল ভোট পেয়েছিল ১৮.৫৩ শতাংশ। কংগ্রেস ৩৩.৭৮ শতাংশ, সিপিএম ৩৩.৫ শতাংশ, বিজেপি ৮.৬৪ শতাংশ। তারপর ভাগীরথী দিয়ে অনেক জল গড়িয়েছে। এখন এলাকার ৭ বিধানসভার মধ্যে, নবগ্রাম, খড়গ্রাম, জঙ্গীপুর, রঘুনাথগঞ্জ, সাগরদিঘি তৃণমূলের। সুতি আর লালগোলা কংগ্রেসের। পঞ্চায়েতে বিরোধীরা শূন্য। অঙ্কের হিসেবে তৃণমূল যে অনেকটাই এগিয়ে, এ কথা জঙ্গীপুরের সকলেই একবাক্যে স্বীকার করছেন।
এর ওপর তৃণমূল এখানে আরও কিছুটা এগিয়ে বিরোধীদের গোষ্ঠীকোন্দলের কারণে। যেমন বিজেপি প্রার্থী মাফুজা খাতুন দক্ষিণ দিনাজপুরের। হিন্দু বিজেপি কর্মীরা তাঁকে মেনে নেননি। আবার নবগ্রাম, সাগরদিঘি, খড়গ্রাম— এই তিন বিধানসভায় সিপিএম প্রণবপুত্রের জন্য ‘কাজ’ করছে বলে অভিযোগ তৃণমূল নেতা তথা রাজ্যের মন্ত্রী জাকির হোসেনের। অন্যদিকে, মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের অভিযোগ, ‘আরএসএস এখানে সরাসরি কংগ্রেসের হয়ে প্রচার করছে।’ মুখ্যমন্ত্রীর এমন অভিযোগের যে সারবত্তা আছে, তা এলাকা ঘুরলেই মালুম হয়।
শুধু আরএসএস যোগ নয়, মুখ্যমন্ত্রীর আরেক অভিযোগ, ‘কংগ্রেস প্রার্থী বসন্তের কোকিল। ৩৬৫ দিন দিল্লীতে থাকে। ভোট হলে আসে।’ সুতির বিড়ি মহল্লায় পা রাখলেই মুখ্যমন্ত্রীর কথার প্রতিধ্বনি শোনা যায় বিড়ি শ্রমিক রুস্তম আলি, মহসিন শেখদের গলায়, ‘৫ বছর আগে দেখেছিলাম। আর কোনওদিন দেখিনি।’ সুতি, রঘুনাথগঞ্জ, জঙ্গিপুরে লাখ লাখ বিড়ি শ্রমিক। মোট ১৬ লাখ ভোটারের মধ্যে প্রায় ৬ লাখ ভোটার বিড়ি শ্রমিক। মন্ত্রী জাকির নিজে বিড়িশিল্পের মালিক। তৃণমূল প্রার্থী খলিলুর রহমানও তাই। ফলে শ্রমিকদের সমস্যা, কেন্দ্রের বঞ্চনা তাঁরা জানেন। সহজে শ্রমিকদের সঙ্গে মিশে যান।
খলিলুরের নির্বাচনী প্রধান জাকির বলেন, ‘নোটবন্দী, জিএসটিতে বিড়ি শিল্পের সঙ্কট দেখা দিয়েছে। শ্রমিকদের জন্য তারাপুরে কেন্দ্র শ্রম-হাসপাতাল করেছিল। গত ৫ বছর ধরে বেহাল হয়ে পড়ে আছে।’ তাঁর দাবি, ‘এলাকায় যা কিছু কাজ হয়েছে সব মমতাদির উদ্যোগে। অভিজিৎবাবু বলতে পারবেন, কোন কাজটি তিনি করেছেন? করেননি। কন্যাশ্রী থেকে শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা— সব রাজ্য সরকার করেছে।’ আবার সাগরদীঘির তৃণমূল বিধায়ক, দলের জেলা সভাপতি সুব্রত সাহা সাফ জানিয়ে দেন, ‘মানুষ এখন তৃণমূলের সঙ্গে আছেন। কংগ্রেস, সিপিএম, বিজেপি সকলে তলে তলে জোট বেঁধেছে তৃণমূলের বিরুদ্ধে। কিন্তু সে আশা ওদের পূরণ হবে না।