সম্প্রতি বাংলা থেকে সস্ত্রীক সোমনাথ মন্দির দর্শনে গিয়েছিলেন নৈহাটির অনির্বাণ পাল। কলকাতা ফেরার আগে হাতে এক দিন সময় ছিল তাঁদের। তাই আমেদাবাদ থেকে গাড়ি ভাড়া করে প্রায় ২০০ কিলোমিটার দূরের ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’টাও এক ঝলক দেখবেন বলে ছুটে গিয়েছিলেন। অনির্বাণবাবু পেশায় ব্যবসায়ী। তাই ব্যবসার গন্ধটা শুরুতেই নাকে গেছিল তাঁর! স্ট্যাচু অব ইউনিটি দেখেই তাঁর প্রথম অভিব্যক্তি, ‘দেখেছেন মশাই কেমন আঁটঘাঁট বেঁধে ব্যবসায় নেমেছে! মোদী তো শিব্রাম চক্কোত্তির কথা মনে করিয়ে দিলেন!’ সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের দিকে তাকিয়েই কথাটা পাড়েন তিনি।
আসলে নর্মদার তীরে ৫৯৭ ফুটের বল্লভভাই প্যাটেল দাঁড়িয়ে রয়েছেন একেবারেই একা। ব্যাকড্রপে সাতপুরা এবং বিন্ধ্যাচল পর্বত। চড়া রোদ ছাড়া আর কিস্যুটি নেই। অনির্বাণবাবু জানান, ‘কিছুই নেই। যেমন দূর, তেমন তুমুল গরম। তার মধ্যেও লোকজন এসেছেন! প্রোমোশন, বুঝলেন মশাই সবটাই প্রোমোশন। আর তার জোরেই এই কিছু না-কে একটা এত্ত বড় বিষয় বানিয়ে ছেড়েছেন মোদী। প্রকৃত বেনিয়া!’ ক্ষোভ উগড়ে দিলেন তিনি। তা এর মধ্যে ব্যবসাটা কোথায়?
তিনি জানালেন, কাছাকাছির মধ্যে কোথাও কোনও রেল স্টেশন বা বিমানবন্দর নেই। গাড়িই ভরসা। আমেদাবাদ থেকে ২০০, আর কাছের শহর বদোদরা থেকে প্রায় ৯০ কিলোমিটার। অনেকে আবার বাস ভাড়া করে আসছেন। ধু-ধু আধা-পাহাড়ি গ্রামীণ এলাকায় থাকার জায়গা প্রায় নেই। নতুন বানানো সরকারি গেস্ট হাউস ‘ভারত ভবন’ বা ‘টেন্ট সিটি নর্মদা’ বানানো হয়েছে, সেখানে থাকতে গেলে ভাল মতো রেস্ত খরচ করতে হয়। কেবাড়িয়া থেকে ওই মূর্তি প্রায় সাড়ে তিন কিলোমিটার। কিন্তু ওই পথ গাড়িতে যেতে গেলে পার্কিং ফি ১৫০ টাকা। আছে বাসের ব্যবস্থা। তাতে জনপ্রতি ৩০ টাকা।
এখানেই শেষ নয়। মূর্তির কাছে যাওয়ার জন্যও রয়েছে নানাবিধ খরচ। যেমন বল্লভভাইয়ের পাদদেশ অবধি পৌঁছতে ১২০ টাকার টিকিট। লিফ্টে করে মূর্তির বুকের কাছ থেকে ‘বার্ডস আই ভিউ’ দেখতে ৩৫০ টাকা। আর যদি লাইনে দাঁড়াতে না চান, তা হলে রয়েছে ১ হাজার টাকার টিকিট। এছাড়া কেবাড়িয়া থেকে মূর্তি এবং পার্শ্ববর্তী সর্দার সরোবর বাঁধ এলাকায় ১০ মিনিটের হেলিকপ্টার-ভ্রমণ হয়। তার জন্য ২ হাজার ৯০০ টাকা মতো খরচ! এত টাকা খরচ করেও কিনা দেখার মতো কিচ্ছুটি নেই। তবে এত ফিরিস্তি এ কারণেই দেওয়া যে এই বিপুল খরচ করে ৪৩ ডিগ্রির দুপুরেও লোকজন আসছেন।
এ প্রসঙ্গে অনির্বাণবাবুর স্ত্রী শুভ্রা পাল সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘আমাদের রাজ্যের পর্যটনকেন্দ্রগুলোর কথা খুব মনে পড়ছে এখানে এসে। ধরুন, বিষ্ণুপুর। এই গরমে আমরা সেখানে কেউ যাওয়ার কথা ভাবতেই পারি না। আর এরা কেমন প্রচার করেই মানুষকে বোকা বানিয়ে যাচ্ছে। লোকজন কেমন হচ্ছে? টিকিট কাউন্টারের কর্মীদের কথায়, ‘এই গরমের প্রচুর লোক হয়। শনি-রবি ভিড় বেশি। প্রতি দিন আমরা ৩৫০ টাকার টিকিট ৭ হাজার বিক্রি করতে পারি। শনি-রবিবার দুপুরের মধ্যেই সেটা ফুরিয়ে যায়।’ এই হিসেবই বলে দিচ্ছে, ‘ব্যবসা’ ভালই হচ্ছে। যতই হোক ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ বলে কথা!
তবে সত্যিই কি এই মূর্তিটি ইউনিটির প্রতীক? না, ‘ইউনিটি’ শব্দটা যে শুধু মূর্তির নামেই রয়েছে। আসলে যে ছ’টা গ্রাম মুছে এই বিপুল মূর্তি এবং পর্যটন কেন্দ্র গড়ে তোলা হয়েছে, তারা যে একাত্ম হতে পারেনি এই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে! ভূমিকা তাড়ভি নামের এক তরুণী নিরাপত্তাকর্মী বলেন, ‘এখানে আগে গ্রাম ছিল। এটা গোরা গ্রামের মধ্যে পড়ে।’ তিনি জানান, পাহাড়-গ্রাম সরিয়ে এখানে বল্লভভাই প্যাটেলকে বসানো হয়েছে। সব মিলিয়ে ৬টা গ্রাম এখনও অধিকৃত হয়েছে— গোরা, লিমড়ি, নয়াগাঁও, ওগাড়িয়া, কেবাড়িয়া এবং কোঠী। তালিকায় আরও রয়েছে। কারণ এখানে সাফারি তৈরি হবে। বাড়ানো হবে পর্যটন কেন্দ্রের ম্যাপ। আর তাতেই পড়ে গেছে আরও অনেক গ্রাম।