প্রার্থী বাছাইয়ের আগে থেকেই গোষ্ঠীকোন্দল প্রকট হয়ে উঠেছিল রাজ্যের গেরুয়া শিবিরের অন্দরে। অবশেষে হাজারও টালবাহানার পর ধাপে ধাপে বাংলায় তাদের প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিজেপি। কিন্তু তারপর প্রকাশ্যে চলে আসে রাজ্যের ৪২টি লোকসভা আসনের জন্য দিল্লীর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রকাশ করা প্রার্থী তালিকা নিয়ে রাজ্য বিজেপি নেতৃত্বের ক্ষোভ। এমনকি কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কঠোর নির্দেশের পরেও লোকসভার প্রার্থী এবং জেলা সভাপতিদের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব এই মুহূর্তে তীব্র আকার নিয়েছে রাজ্য বিজেপিতে। সূত্রের দাবি, প্রথম দফার ভোট শুরুর আগে কলকাতায় দক্ষিণবঙ্গের ৩৪ জন বিজেপি প্রার্থীকে নিয়ে গোপন বৈঠক করা হয়েছিল। সেখানে ডাকা হয়েছিল দলের জেলা সভাপতি এবং পর্যবেক্ষকদের। গভীর রাতের সেই বৈঠকে দলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক কৈলাস বিজয়বর্গীয়, সহ সাধারণ সম্পাদক (সংগঠন) শিবপ্রকাশ হাজির ছিলেন।
দিল্লীর ওই দুই নেতা একাধিক জেলা সভাপতির উদ্দেশ্যে স্পষ্ট বলেছিলেন, প্রার্থীদের সঙ্গে একশো শতাংশ সহযোগিতা করতে হবে। পরবর্তী সময়ে অসহযোগিতার অভিযোগ উঠলে সংশ্লিষ্ট নেতৃত্বের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু সেই হুমকি যে কোনও কাজেই আসেনি, তা স্পষ্ট হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের একাধিক বিজেপি প্রার্থীর নালিশের বহর দেখে। দলের রাজ্য কমিটির এক নেতার দাবি, দিলীপ ঘোষ, রাহুল সিনহার মতো প্রভাবশালী বিজেপি প্রার্থীদের নিয়ে কোনও অসুবিধা নেই। সমস্যা তৃণমূল-সিপিএম-কংগ্রেস থেকে সদ্য গেরুয়া শিবিরে এসে টিকিট পাওয়া প্রার্থীদের নিয়ে। কারণ, অনেককেই এক জেলা থেকে সরিয়ে অন্য জেলায় প্রার্থী করা হয়েছে। ফলে স্থানীয় এলাকা সম্পর্কে তাঁদের কোনও ধারণা নেই। বদলে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলের জেলা সভাপতিরা নিজেরাই লোকসভায় দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। তাঁরা টিকিট না পাওয়ায় ক্ষোভের বশে এখন দলের প্রার্থীদের লেজে খেলাচ্ছেন।
সূত্রের দাবি, এ নিয়ে রাজ্য বিজেপির শীর্ষ নেতাদের কাছে জেলা নেতৃত্বের নামে অভিযোগ জানিয়েছেন একাধিক প্রার্থী। এক প্রার্থীর কথায়, জেলা সভাপতি আমার সঙ্গে সব সময় থাকছেন। সংবাদমাধ্যমে আমাদের দু’জনের হাসিমুখের ছবি প্রকাশ হচ্ছে। কিন্তু সাংগঠনিক স্তরে বহু ক্ষেত্রে আমার বিরুদ্ধে উনি কাজ করছেন। রীতিমতো অসহায় দেখাচ্ছিল বিজেপির ওই প্রার্থীকে। তিনি বলেন, কী করা যাবে? বেশি বলতে ভয় পাচ্ছি। কারণ, প্রচার, ভোটের স্লিপ বিলি, বুথ পাহারা সহ একাধিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে জেলা সভাপতিদের উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করতে হবে। তাই এ নিয়ে আরও বাড়াবাড়ি হোক, চাইছি না। এ বিষয়ে দলের এক রাজ্য নেতা বলেন, টাকা এর অন্যতম একটা কারণ। ভোটে দাঁড়াতে পারলেই দিল্লীর তরফে মোটা টাকার জোগান পাওয়া সুনিশ্চিত।
প্রসঙ্গত, দীর্ঘদিন ধরে বিরোধীদের চোখে চোখ রেখে লড়াই করা পুরনো বিজেপি নেতারা অনেকেই এবার টিকিট বিলি নিয়ে যথেষ্ট ক্ষুব্ধ। তার উপর অন্য দল থেকে দু’দিন আগে বিজেপিতে এসে নেপোয় মারে দইয়ের ঢঙে টাকা নিয়ে অনেক প্রার্থীই হম্বিতম্বি শুরু করেছেন। ভোটের প্রচার, সংগঠন বিস্তার সহ বিবিধ খাতে টাকা বরাদ্দ করা নিয়ে অনেক কেন্দ্রে প্রার্থী ও জেলা সভাপতিদের মধ্যে মতবিরোধ তীব্র আকার নিয়েছে। ওই রাজ্য নেতার বক্তব্য, অন্যান্য দলে জেলা স্তরে একজন সভাপতি থাকেন। কিন্তু বিজেপির একটি জেলায় একাধিক সভাপতি রয়েছেন। উদাহরণ দিয়ে তিনি বলেন, গোটা কলকাতায় বিজেপির চারজন সাংগঠনিক সভাপতি রয়েছেন। সেই সাংগঠনিক জেলাগুলি হল—কলকাতা উত্তর, কলকাতা দক্ষিণ, কলকাতা উত্তর শহরতলি, কলকাতা দক্ষিণ শহরতলি। স্বভাবতই অনেক লোকসভা ক্ষেত্রের সীমানা একাধিক জেলা সভাপতির অধীনে পড়ে গিয়েছে। সব পক্ষকে ঐক্যবদ্ধ করে ভোটে নামানোর ক্ষেত্রেও সমস্যা দেখা দিয়েছে।
প্রসঙ্গত, বিজেপির কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব রাজ্য নেতাদের উদ্দেশ্যে যতই বলুন, নিজেদের মধ্যে মনোমালিন্য ভুলে জয়ের লক্ষ্যে সবাইকে এক হয়ে কাজ করতে হবে। জেলা সভাপতিদের সংশ্লিষ্ট কেন্দ্রের সাংগঠনিক শক্তি মজবুত করার কাজে সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপাতে হবে। আদতে তাতে বিশেষ লাভ হয়নি। কারণ এ কথা অস্বীকার করার জায়গাই নেই যে, একেবারে অচেনা-অজানা প্রার্থীদের নিয়ে বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে বিজেপির স্থানীয় নেতা-কর্মীদের। আনকোরা প্রার্থীদের সঙ্গে দলের কর্মী-সমর্থকদের পরিচয় করাতে গিয়ে রীতিমতো বিপাকে পড়ছেন তাঁরা। যার ফলে ভোট শুরু হয়ে গেলেও এখনও ক্ষোভের আগুন নেভেনি রাজ্যের গেরুয়া শিবিরে। এখানে এখনও গ্যাং ওয়ার চলছে বিজেপি প্রার্থী এবং দলের জেলা নেতৃত্বের মধ্যে।