শুধু ভোট মরশুম ছাড়া বছরের বাকি সময় উপেক্ষিতই থেকে যান তাঁরা। বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই ক্রমশ অবস্থার অবনতি হতে থাকে তাঁদের। গত ৫ বছরে হালহকিকত দেখে এ কথা হলফ করেই বলা যায় যে মোদী জমানায় ভাল নেই সংখ্যালঘুরা। শুধু দিদির রাজ্যেই তাও সুখে শান্তিতে বাস করতে পারছেন তাঁরা। বাংলার ছবিটা কিছুটা হলেও ব্যতিক্রমীই বটে।
এ রাজ্যে সংখ্যালঘুরা কেমন অবস্থায় আছেন? এর উত্তর খুঁজতে গিয়ে রাজ্যে বস্ত্রশিল্পের অন্যতম ঠিকানা মেটিয়াবুরুজে গিয়ে জানা গেল, বিজেপি সরকারের নোটবন্দী, জিএসটি লাগু হওয়ার পরে অনেক ওস্তাগার ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। কলকাতা পুরসভার ১৪১ নম্বর ওয়ার্ডের অন্তর্গত সফি কাঠগোলায় পুরুষানুক্রমে প্রায় ষাট বছর ধরে কাপড় তৈরির ব্যবসা করেন ওস্তাগার সরফুল আলম।
সরফুলের কথায়, ‘আমার অধীনে ৭৫ জন কর্মী কাজ করছেন। নোটবন্দী, জিএসটি চালু হওয়ার পর এখন কর্মীর সংখ্যা মাত্র ১৫। একটি সেলাই তৈরির কারখানা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মাত্র একটি কারখানা রেখেই কোনওক্রমে ব্যবসা চালাতে হচ্ছে।’ দেশের বিভিন্ন প্রান্ত ছাড়াও বিদেশেও মেটিয়াবুরুজ থেকে তৈরি কাপড় রপ্তানি হয়। নোটবন্দী আর জিএসটি-র জেরে এখন তুলনায় কাপড় রপ্তানির হার কমেছে।
হাওড়া হাট সংগ্রাম সমিতির সভাপতি তথা কলকাতা পুরসভার প্রাক্তন তৃণমূল কাউন্সিলর মইনুল হক চৌধুরীর বাড়ি নাদিয়াল। মইনুলের নাদিয়ালের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেল, একদা রমরমিয়ে চলা তাঁর বস্ত্র কারখানাটি এখন বন্ধ। মইনুলের কথায়, ‘আগে আমার এখানে ৪০ জন কর্মী কাজ করতেন। এখন সেখানে ৪ জন। নোটবন্দী, জিএসটি চালু হওয়ার পর এখন কাটা কাপড়ের বেশির ভাগই বাইরের থেকে বানিয়ে নিই। এর ফলে খরচ তুলনায় কম পড়ে।’
গার্ডেনরিচের আর এক ওস্তাগার মেহতাব আলিরও একই দুর্দশা। মেহতাবের কথায়, ‘মেটিয়াবুরুজের বেশিরভাগ মানুষ লেখাপড়া কম জানেন। জিএসটিতে ছোট শিল্পের ছাড় পাওয়া গেলেও সেই ছাড় মিলতে অতিরিক্ত কর্মী রাখার জন্য অনেক ছোট ব্যবসায়ী ব্যবসা বন্ধ করে দিয়েছেন। আগের তুলনায় আমিও কর্মীর সংখ্যা অর্ধেক কমিয়ে দিয়েছি। কাপড় তৈরির সংখ্যা প্রায় পঞ্চাশ শতাংশ কমিয়ে দিয়েছি।’
২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী, ভারতে মোট জনসংখ্যার ২০.২ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। এর মধ্যে ১৪.২ শতাংশ মুসলিম। বাকি ৬ শতাংশ শিখ, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ, জৈন-সহ অন্যান্যরা। রাজ্যে আবার মোট জনসংখ্যার ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ভুক্ত। রাজনীতিক বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, ভারতে মুসলমানরা গত কয়েক বছর ধরে যে পরিস্থিতির শিকার হয়েছেন অতীতে এ রকম অবস্থার কখনও সৃষ্টি হয়নি।
সাম্প্রদায়িক হিংসার বিভিন্ন ছবি ঘিরে সাম্প্রতিক সময়ে শোরগোল উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়া-সহ সমস্ত জায়গায়। আমজনতার মধ্যেও এ নিয়ে চর্চা-বিতর্ক চলছেই। সাম্প্রতিক রাজনীতিতে ‘ধর্ম’ নিয়ে মাতামাতি করা হচ্ছে এবং ‘অসহিষ্ণুতা’র পরিবেশে সংখ্যালঘুদের ‘টার্গেট’ করা হচ্ছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। কিন্তু মুসলিমদের একাংশ নীরব বলে জানাচ্ছেন রাজনৈতিক মহল। কারণ, তাঁরা কোনও ভাবে নিরাপত্তার অভাব বোধ করছেন বলেই মনে করা হচ্ছে।
তবে ভারতের অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় এ রাজ্যে সংখ্যালঘুরা অনেকটাই নিরাপদ বলে মনে করছেন সমাজের বিভিন্ন পেশার মানুষরা। হাওড়ার একটি কলেজের শিক্ষক তথা সংখ্যালঘুদের নিয়ে কাজ করা ‘বাংলা সংস্কৃতি মঞ্চ’-এর সভাপতি সামিরুল ইসলামের কথায়, ‘ভারত সহনশীল দেশ। আমরা দেশের জন্য গর্ব অনুভব করি। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে দেশজুড়ে যে ভাবে অসহিষ্ণুতার আবহাওয়া ছড়িয়েছে তাতে ভোটে প্রভাব পড়তে বাধ্য।’
তিনি আরও বলেন যে, ‘কাশ্মীরের পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার ঘটনার পরবর্তী সময়ে যে ভাবে দেশপ্রেমকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে দেখানো হচ্ছে, তা ভোটের আগে রাজনৈতিক জিগির ছাড়া কিছু নয় বলে মনে করেন অধ্যাপিকা মীরাতুন নাহার।’ তাঁর কথায়, ‘সংখ্যালঘুরা এই গিমিকে খুব বেশি প্রভাবিত হবেন না বলে মনে করি।’ বঙ্গীয় ইমাম অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান মহম্মদ ইয়াহিয়ার দাবি, ‘তৃণমূল শাসিত এই রাজ্যে সংখ্যালঘুরা অনেকটাই নিরাপদ। তাঁরা তৃণমূলের পক্ষেই রায় দেবেন।’
গৌরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মেহেদি হাসান মনে করেন, ‘ধর্ম আর রাজনীতিকে মিশিয়ে সরবত করে খাওয়ানো হচ্ছে। দেশ যে সবার, সেই আত্মবিশ্বাসের ভিত নাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সব সময়। গোরক্ষকদের তাণ্ডবও কারও অজানা নয়।’ বৌদ্ধ ধর্মগুরু অরুণজ্যোতি ভিক্ষুর মত্র, ‘যে কোনও সরকারের উচিত, সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা দেওয়া। কিন্তু দেশে গত কয়েক বছর ধরে দলিত ও মুসলিমদের ওপর যে ভাবে ক্রমাগত আঘাত এসেছে তা চিন্তার বিষয়।’
পেশায় শিক্ষক শেখ শামসুদ্দিন আবার সাফ জানাচ্ছেন, ‘এ রাজ্যের শাসকেরা সংখ্যালঘুদের মনে একটা আস্থা অর্জন করতে পেরেছে, এটা মানতেই হবে।’ ওয়েস্টবেঙ্গল অ্যাসোসিয়েশন অব খ্রিস্টান স্কুলস-এর সম্পাদক মলয় ডি কোস্টাও বলছেন, ‘অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যালঘুরা বেশ নিরাপদেই রয়েছে। এখানে সংখ্যালঘু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলি শান্তিপূর্ণভাবেই কাজ করছে। এটা একটা শুভ ইঙ্গিত।’