খোদ মোদীর রাজ্যেই ‘আচ্ছে দিনে’র ঠেলায় আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছিলেন তাঁর বাবা। আর বাবার বেছে নেওয়া সেই আত্মহত্যার পথই কেড়ে নিয়েছে তাঁর জীবনের সমস্ত স্বপ্ন। গত ৬ মাস ধরে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার লড়াই চালাচ্ছে দশম শ্রেণির পরীক্ষায় ৭৪ শতাংশ নম্বর পাওয়া মেয়েটা। নাম অঞ্জলি। এখন স্থানীয় হোটেলে বাসন মাজার কাজ করে সে। একটাই প্রশ্ন এখন ঘুরপাক খাচ্ছে তাঁর মনে, ‘আচ্ছা চাষ করা কি পাপ?’
গত অক্টোবরের ২৫ তারিখ ভোরে জামনগর থেকে কিলোমিটার পঞ্চাশেক দূরে ভাবড়ি গ্রামের সকলে দেখেছিল, খেতের পাশের ইলেকট্রিক পোস্টে ঝুলছেন রানাভাই গাগিয়া (৪৯)। বেশ কিছু দিন ধরেই নাকি অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছিলেন তিনি। নেতা-মন্ত্রীর দরজা থেকে সরকারি অফিস পর্যন্ত সব জায়গাতেই ঘুরে বেড়িয়েছেন তিনি। ইনসিওরেন্সের অফিসও বাদ দেননি। আসলে রানাভাইয়ের চাষের খেত তার কিছু দিন আগেই শ্মশান হয়ে গিয়েছিল। এদিকে জমিতে পোতা বাদাম আর কাপাস জলের অভাবে জ্বলে ছাই। আর অন্যদিকে, বাজারে তত দিনে লাখ তিনেক টাকা দেনা হয়ে গিয়েছে। শেষমেশ ঝুলে পড়া ছাড়া আর কোনও উপায়ই খুঁজে পাননি রানাভাই।
ছ’মাস আগের সেই ঘটনার কথাই ঢোক গিলতে গিলতে বলছিল অঞ্জলি। ভাড়াবাড়ির খুপচিতে খাটিয়ায় পাশে বসা তাঁর মা কবিতাবেন তখন শাড়ির খুঁটে চোখ মুছছেন। অঞ্জলির বয়স সদ্য ১৫ ছাড়িয়েছে। বাবার আত্মহত্যার পর তাঁর থেকে চার বছরের বড় দাদা জয়েশ কলেজে পড়া ছেড়ে জামনগরের একটা কারখানায় কাজ জুটিয়েছেন। দিনপ্রতি মেলে ১৫০ টাকা। ১৭ বছরের দিদি শীতল আর ১৩ বছরের বোন কাজলও ছোটখাটো কারখানায় কাজ করেন। তাঁদের প্রাপ্য আরও কম। ছোট ভাই ভরত পড়াশোনা করলেও নিয়মিত স্কুলে যাওয়া হয় না তাঁর। গত চার মাস ধরে তাঁদের ঠিকানা আর ভাবড়ি নয়, জামনগর শহর থেকে কিছুটা দূরের দরে়ড গ্রামে দেড় হাজার টাকার ভাড়াবাড়ি। সেখানেই কোনও রকমে টেনেটুনে দিন কাটছে গাগিয়া পরিবারের।
অঞ্জলিকে যখন জিজ্ঞেস করা হয়েছিল সে কোন ক্লাসে পড়ে, তখন একটা চাপা কষ্ট নিয়েই সে জানায়, ‘ক্লাস টেনে পড়তাম। ৭৪ শতাংশ নম্বর পেয়েছিলাম। ইলেভেনে আর ভর্তি হওয়া হয়নি। দাদা-দিদিরা কোথায় টাকা পাবে। আমি তাই কাজে ঢুকে পড়েছি।’ কী কাজ জিজ্ঞেস করতেই পাশ থেকে মা কবিতাবেন জানান, ‘ও এ পাড়ার একটা হোটেলে দু’বেলা বাসন মাজে।’ স্বামী হারানোর শোক তো রয়েছেই, তার ওপর কবিতাবেনের এখন চিন্তা, ‘তিন মেয়ের বিয়ে কী করে দেব? ওরা পড়াশোনায় এত ভাল ছিল! হোটেল-কারখানায় কাজ করা মেয়েকে সমাজে তো কেউ ভাল চোখে দেখে না!’ সেইসঙ্গে তিনি এও বলেন, ‘আমার বাচ্চারা সবাই মিলে চেষ্টা করছে, বাবার ধার যাতে দ্রুত শোধ করা যায়। সরকার পাশে থাকলে সুবিধাই হত।’
এটা কোনও একটা গাগিয়া পরিবারের কাহিনি নয়। গোটা সৌরাষ্ট্রে গত সেপ্টেম্বর মাস থেকে ২৮ জন কৃষক আত্মহত্যা করেছেন! সংখ্যাটা নিয়ে রাজ্যের বিজেপি সরকার এবং কেন্দ্রের মোদী সরকারের খুব একটা হেলদোল আছে বলে কৃষক মহল মনে করে না। যেমন লালপুরের রজনী খুন্তি নিজের ক্ষোভ উগড়ে দিয়ে বলেন, ‘একে তো সার এবং কীটনাশকের দাম বেড়েছে গত কয়েক বছরে। তার ওপর বৃষ্টি প্রায় হয়ইনি। সেচেও জল মেলে না। ফসল শুকিয়ে কাঠ। আর যার যেটুকু ফসল বিক্রিযোগ্য, তার ন্যূনতম সহায়ক মূল্য পাওয়া কার্যত অসম্ভব।’ প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমার কথা উঠতেই তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘আমরা সব ছোট চাষি। ফসল বিমার প্রিমিয়াম আমাদের অনেকের কাছেই বেশি ঠেকে। লাভের গুড় পিঁপড়েকে দিয়ে দেওয়ার মতো। কাজেই অনেক চাষি ওই বিমা করে না। আর যারা করে, তারা বিপদের দিনে টাকা পায় না। এটাই আমাদের অভিজ্ঞতা।’
জয়েশও তেমন অভিজ্ঞতার কথাই শোনালেন। আত্মহত্যা করার কয়েক দিন আগে তাঁর বাবা রানাভাই গিয়েছিলেন বিমা সংস্থার অফিসে। জলের অভাবে তাঁর ফসল নষ্ট হয়ে গিয়েছে, এ কথা জানানোর পর সেই অফিস থেকে লোকজন আসে। খেত পরীক্ষা করে জানানো হয়, এই জমিতে কোনও বীজই পোঁতা হয়নি! জয়েশের কথায়, ‘মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে বাবার। সে দিন বিকেলে বাড়ি ফিরে এসেছিলেন। পর দিন ভোরেই…। বিমার ক্ষতিপূরণটা পেলে বাবাকে হয়তো মরতে হত না।’ আক্ষেপ ছেলের। উল্লেখ্য, বৃষ্টি এবার কম হয়েছে ঠিকই। রাজ্য সরকার খরাও ঘোষণা করেছে কোনও কোনও জায়গায়। কিন্তু, সেই ঘোষণার মাপকাঠি নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। নিজেদের ইচ্ছে মতো তালুককে খরা ঘোষণা করা হয়েছে বলে অভিযোগ।
সৌরাষ্ট্রে কৃষকদের অধিকার নিয়ে কাজ করা পালাভাই আম্বালিয়া বলেন, ‘কোন গ্রামে কতটা বৃষ্টি হয়েছে, তা মাপার যন্ত্র নেই। নিজেদের ইচ্ছে মতো তালুককে খরা কবলিত বলে দাগিয়ে দেওয়া হয়েছে। তার বাইরে তো হাজারো গ্রাম। সেগুলোর কী হবে? অনেক জায়গাই রয়েছে, যেখানে প্রথম দফায় ভাল বৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু সেকেন্ড স্পেলে আর বৃষ্টিই হয়নি। সেই কৃষকদের কী হবে? জবাব কে দেবেন, নরেন্দ্রভাই মোদী না বিজয় রূপানি?’ অভিযোগ শুধু পালাভাইয়ের নয়। জুনাগড় কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক স্বামীনাথন বি-ও জানান, ‘বৃষ্টিপাতের পরিমাণের ওপর নির্ভর করে ৫১টি তালুককে খরা কবলিত বলে ঘোষণা করা হয়েছে। কিন্তু, তাতে আদৌ কোনও লাভ হয়নি! কৃষকরা যে অন্ধকারে ছিলেন, তার থেকে আরও আঁধারে ডুবছেন তাঁরা।’
এ বারের নির্বাচনে সৌরাষ্ট্রের এই কৃষক ক্ষোভই বিজেপির মাথাব্যথার কারণ। বিষয়টি নরম করতে নেতারা ইতিমধ্যেই পথে নেমেছেন। জুনাগড়েও ইতিমধ্যেই জনসভা করে গিয়েছেন মোদী। কিন্তু এতে ক্ষোভ মেটেনি কৃষকদের। তাঁদের দাবি, বিজেপি কৃষকদের জন্য কিছুই করেনি। এবার কাপাস উৎপাদন গত ১০ বছরের মধ্যে সব চেয়ে কম হয়েছে। বাদামও। জোয়ার-বাজরা-গম-আখের হালও বেশ খারাপ। এর মূল কারণই হল এই সরকারের কোনও কৃষি নীতি নেই। প্রিমিয়াম দেওয়ার পরেও ফসল বিমার একটা টাকাও পান না চাষিরা! অথচ নিয়মে বলা আছে, খরা কবলিত এলাকায় জরুরিভিত্তিতে বিমার ২৫ শতাংশ টাকা দিয়ে দিতে হবে। কোথায় কী! উল্লেখ্য, বিধানসভা নির্বাচনেই সৌরাষ্ট্র বুঝিয়ে দিয়েছে তারা কাকে চায়। কৃষক অসন্তোষের ফলে খোদ মোদীর গড়েই যে এখন বেজায় বিপাকে পড়েছে বিজেপি, এ কথা অস্বীকার করার জায়গাই নেই।