‘গত দেড় বছরে যে দার্জিলিংকে দেখছি তা আগে কখনও দেখিনি। এত উন্নয়ন এত অল্প সময়ে সম্ভব!’ মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের প্রশংসায় নিজে মুখেই এ কথা বললেন দার্জিলিঙের নেহরু রোডে চা বিক্রেতা মোহন প্রসাদ। তিন পুরুষ ধরেই দার্জিলিঙে তিনি। জানালেন, পাহাড়ের স্বার্থে ঢালাও উন্নয়ন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী। বদলে যাওয়া এই দার্জিলিঙেই এবার ভোট। গুরুংয়ের আন্দোলন পরবর্তী সময়ে প্রথম ভোট। মোট বিধানসভার আসন সাতটি। পাহাড়ে তিন আসন দার্জিলিং, কার্শিয়াং, কালিম্পং। সমতলে চার— শিলিগুড়ি, মাটিগাড়া নকশালবাড়ি, ফাঁসি দেওয়া ও চোপড়া। এবারের লড়াইটা আসলে অতীতের দিশাহীনতার সঙ্গে উন্নয়নের।
চকবাজার থেকে ঝাঁ চকচকে লেবং কার্ট রোড ধরে বড়জোর তিন কিলোমিটার গেলেই সিংমারি। সেখানেই নর্থ পয়েন্ট স্কুলের উল্টোদিকে বেগুনি-সাদা রঙের চারতলা বাড়িটা চোখে পড়বে। সাধারণ এই বাড়ির ওপরের দুটি তলা বন্ধ। নিচের তলায় কয়েকটি দোকানপাট, একটি ছোট হোটেলও। নিছক সাদামাটা এই বাড়ি থেকেই গত এক দশক ধরে নিয়ন্ত্রিত হয়েছে পাহাড়ের রাজনীতি। এটাই ছিল বিমল গুরুং নিয়ন্ত্রিত গোর্খা জনমুক্তি মোর্চার সদর দফতর। পাহাড়ে গুরুং বিরোধী জনরোষ তীব্র হওয়ার পর থেকে ক্রমশ জৌলুস হারিয়েছে এই বাড়ি।
এর ঠিক উল্টোদিকে নর্থ পয়েন্ট স্কুলের গা ঘেঁষে নেমে গেছে পাতলেবাসের রাস্তা। ঢালু সেই রাস্তা দিয়ে মিনিট কুড়ি হেঁটে নেমে গেলেই চোখে পড়বে পোড়া গাড়ির কঙ্কাল। একটা নয়, পর পর দুটো। কিছুটা এগিয়ে বিমল গুরুংয়ের বাড়ি। তার সামনে আরও একটা পুড়ে যাওয়া গাড়ি। এক সময় যে বাড়ি গমগম করত কর্মী–সমর্থকদের আনাগোনায়, যে বাড়ি থেকে গোর্খাল্যান্ড বিরোধীদের উদ্দেশ্যে সুর চড়াতেন গুরু, তা এখন নিছকই খণ্ডহর। সামনে ভেঙে পড়া নিরাপত্তারক্ষীর ঘরটির দেওয়ালে সাঁটানো প্রশাসন, আদালত থেকে জারি করা একাধিক নোটিস। সব মিলিয়ে পাহাড়ের ঢালে চুপ করে জমে আছে একখণ্ড নিস্তব্ধতা।
আক্ষরিক অর্থে নিস্তব্ধতাই বটে। গোটা দার্জিলিঙের সঙ্গে তুলনায় এই এলাকার অবস্থান একেবারে বিপ্রতীপ। ২০১৭ সালের ৮ জুন থেকে শুরু হওয়া আন্দোলন, ১০৪ দিনের টানা বনধের রাজনীতি থেকে এখন অনেক দূরে পাহাড়। মুখ্যমন্ত্রীর সময়োচিত হস্তক্ষেপ ও একদা বিমল সঙ্গী বিনয় তামাং-অনীত থাপাদের ইতিবাচক ভূমিকায় বদলে গেছে পাহাড়টাই। দার্জিলিং থেকে কালিম্পং, গুরুংয়ের ছায়াও এখন চোখে পড়ে না। লরেটো কলেজের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে একুশ বছর কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁর ঝুলিতে। বললেন, ‘পাহাড় এক সন্ধিক্ষণের সামনে। সামনে এক নতুন সম্ভাবনা। পাহাড়ের মানুষ এবার সঠিক সিদ্ধান্তই নেবেন।’
কার্শিয়াং বাজারে দাঁড়িয়ে স্কুল শিক্ষক নর্দেন রাই বললেন, “এবারই প্রথম কোনও নির্বাচনে পৃথক রাজ্যের আবেগকে সরিয়ে রেখে ইস্যু হয়ে উঠেছে উন্নয়ন। ‘পর্জা-পাট্টা’ (জমির অধিকার)-র দাবির সঙ্গে সমান গুরুত্ব পাচ্ছে আত্মপরিচয়ের প্রশ্নও। এটাই সবথেকে ইতিবাচক দিক।” আর এবার ভোটে এই দুই ইস্যুই তুরুপের তাস তৃণমূলের। হাতেগোনা কয়েকজন গুরুং অনুগামী ও পাহাড়ের রাজনীতিতে রাতারাতি ‘সুযোগ সন্ধানী’ তকমা পেয়ে যাওয়া জিএনএলএফ-কে সঙ্গে নিয়ে ভোটযুদ্ধে অবতীর্ণ বিজেপিও।
কিন্তু ২০০৯ ও ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনে বিপুল ভোটে জিতে আসা বিজেপির বোঝা তাদের অতীত। চটজলদি ভোটে জেতার কারণে আগু-পিছু না ভেবে গোর্খাল্যান্ড গঠনের প্রতিশ্রুতি দেওয়া যে বুমেরাং হয়েছে, তা আড়ালে আবডালে স্বীকার করছেন নেতারাই। তার ওপর দার্জিলিঙের বিদায়ী সাংসদ তথা কেন্দ্রীয়মন্ত্রী সুরিন্দর সিং আলুওয়ালিয়াকে দীর্ঘদিন দেখেনি পাহাড়। এক সময় তো তাঁর নামে পাহাড়ের থানায় মিসিং ডায়েরিও হয়। এই অবহেলাকেও এত তাড়াতাড়ি ভুলে যেতে রাজি নন পাহাড়বাসী। পাশাপাশি মণিপুরের বাসিন্দা তথা পাহাড়ের ‘বহিরাগত’ বিজেপি প্রার্থী রাজু বিস্তের লড়াই পাহাড়ের একজন ভূমিপুত্রের সঙ্গে। যার ফলে পাহাড় হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কাই এখন জোরদার হচ্ছে গেরুয়া শিবিরে।