দীর্ঘদিন ধরে মানুষের মনে জমে থাকা ক্ষোভই বাইরে চলে এসেছিল চোদ্দো মাস আগে। প্রভাব পড়েছিল ভোটবাক্সে। এবং তার ফলাফল হিসেবেই ত্রিপুরার বাম দুর্গের পতন ঘটে। এই মুহূর্তে রাজ্যের মসনদে বিজেপির বিপ্লব দেব। কিন্তু এক বছর দু’মাস পরেই অদ্ভুত ভাবে বদলে গেছে ত্রিপুরায় গেরুয়া শিবিরের অবস্থাও। ক্ষমতায় থেকেও মানুষের আকাঙ্ক্ষা এবং প্রয়োজন পূরণ না করতে পারায় প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা বা অ্যান্টি এস্টাবলিশমেন্টের ঢেউ আঘাত করছে অন্যতম প্রধান দুই প্রতিপক্ষ সিপিএম ও বিজেপিকে। এটাই ত্রিপুরায় এবারের লোকসভা নির্বাচনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
প্রসঙ্গত, ১৯৭৮ সাল থেকে ২০১৮ পর্যন্ত দুই দফায় মোট ৩৫ বছর এই রাজ্যে ক্ষমতায় ছিল সিপিএম। শেষ দফায় টানা ২৫ বছর। আর বিজেপি গত এক বছর। মাঝে ১৯৮৮ থেকে ’৯৩ পর্যন্ত রাজ্যে কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের কাজের জন্য মানুষের মধ্যে যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছিল, তা সময়ের কারণে এখন ফিকে। তবে গোষ্ঠীকোন্দল-সহ একাধিক কারণ রাজ্যে বেহাল দশা বিজেপির। আর আগরতলা, উদয়পুর, বিশালগড় সহ ত্রিপুরার নানা প্রান্তের সাধারণ মানুষের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গিয়েছে, সিপিএমের সময়ে না পাওয়ার বঞ্চনা, সব বিষয়ে দলবাজি, দুর্নীতি, তোলাবাজির ক্ষোভ মানুষের মধ্যে এক বছর পরেও রয়ে গিয়েছে।
যেমন উদয়পুরের বাসিন্দা যুবক বাসুদেব দাস বলেন, ‘সিপিএমের সময়ে তো চাকরি বাকরি সব মিলত পার্টি করলে। যোগ্যতাটা কোনও বিষয় ছিল না। তবে নতুন সরকার এসে যে এখনও চাকরি দেয়নি, এটাও ঠিক।’ বস্তুত শিল্প-বাণিজ্য ক্ষেত্রে ত্রিপুরার মতো পিছিয়ে পড়া রাজ্যে চাকরি বাকরির সুযোগ এমনিতেই কম। সরকারি ক্ষেত্রে চাকরি মানুষের একটা বড় ভরসা। গত এক বছরে বিজেপি সরকার রাজ্যে সরকারি চাকরি না দিতে পারা মানুষের ক্ষোভের একটা বড় কারণ।
এছাড়া, সিপিএমকে তাদের শাসনে হওয়া নানা অনিয়ম, দলবাজি ও দুর্নীতির ধাক্কা এখনও পোহাতে হচ্ছে। বাম আমলে এই রাজ্যে বড় ধরনের চিটফান্ড কেলেঙ্কারি হয়েছিল। তৎকালীন শাসক দলের নেতাদের বিরুদ্ধে যে সব অভিযোগ ওঠে, তা এখনও তাড়া করে বেড়াচ্ছে সিপিএমকে। পূর্ব ত্রিপুরা কেন্দ্রের প্রার্থী জিতেন্দ্র চৌধুরীকে নিয়ে তাঁর বিধানসভা এলাকা ঋষ্যমুখে সম্প্রতি প্রচারে এসেছিলেন সিপিএম আমলের দাপুটে মন্ত্রী ও নেতা বাদল চৌধুরী। চিটফান্ডের খোয়া যাওয়া টাকা কবে ফেরত পাওয়া যাবে, এই প্রশ্ন তুলে তাঁদের ঘিরে প্রচুর মানুষ বিক্ষোভ দেখায়। এমনকি, সিপিএম নেতাদের বের করে আনতে পুলিশকে রীতিমতো লাঠিচার্জ করতে হয়।
অন্যদিকে, ক্ষমতায় আসার আগে সরকারি দফতরে ৫০ হাজার শূন্যপদ পূরণ, সব পরিবার থেকে কাজের সুযোগ, মিসড কল দিলেই চাকরি… এই সব প্রতিশ্রুতি যে মানুষকে বিজেপির দিকে অনেকটাই টেনেছিল, সেব্যপারে কোনও সন্দেহ নেই। এসব প্রতিশ্রুতি এখনও পূরণ না হওয়ায় মানুষের মধ্যে ক্ষোভ যে জন্মেছে, তা পথেঘাটে কথা বললেই বোঝা যাচ্ছে। যুবকদের স্মার্টফোন দেওয়া, গরিবদের ভাতা বাড়িয়ে দু’হাজার টাকা করা, ১০০ দিনের কাজের পারিশ্রমিক প্রায় দ্বিগুণ করে ৩৪০ টাকা করা প্রভৃতিও এখন কার্যকর হয়নি।
বিজেপি অবশ্য ভোটের প্রচারে এই প্রতিকূল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বিস্তর চেষ্টা চালিয়েছে। মুখ্যমন্ত্রী বিপ্লব দেব, উপমুখ্যমন্ত্রী জিষ্ণু দেববর্মা-সহ বিজেপির নেতা মন্ত্রীরা বিভিন্ন এলাকায় প্রচারে গিয়ে গত এক বছরে সরকার কী কী কাজ করেছে, তার খতিয়ান তুলে ধরছেন। দেশে মোদী সরকার থাকলেই ত্রিপুরা আরও উন্নত হবে, এটাও বলা হচ্ছে। তবে এরপরও মানুষের চাকরি না পাওয়ার বিষয়টি কিন্তু বড় হয়ে উঠছে। বিজেপি নেতারা অবশ্য এখন সাফাই গাইছেন, কর্মসংস্থান মানে সবাই সরকারি চাকরি পাবেন, এমন নয়। যে উন্নয়ন পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে, তাতে কর্মসংস্থান বাড়বে। তবে তাতেও আর চিড়ে ভিজছে না।