মানুষের মমতা

আমরা বিধ্বস্ত, আমরা ক্লান্ত, আমরা তার গতির সঙ্গে পাল্লা দিতে পারছি না। যার সম্পর্কে এই কথাগুলি বলছি, তিনি কিন্তু নির্বিকার। সেই ২০০১ থেকে নিজের পেশার সুবাদে তার সঙ্গে রয়েছি, ১৯শে এসেও দেখছি তার গতিতে কোন ভাঁটার টান নেই। আমি বলছি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা। বলতে গেলে অন্ধ্র থেকেই তার নির্বাচনী সফর শুরু হয়ে গেছে। আসাম হয়ে আমরা ঢুকে পড়েছি উত্তরবঙ্গে, প্রতিদিন দুটো করে নির্বাচনী সভাতে ঘন্টাখানেক সময় তৃণমূলনেত্রীকে বক্তব্য রাখতে হচ্ছে। এর সঙ্গে আছে কিছু জরুরি প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন; রাজ্যের নানা প্রান্তে দলের সৈনিকদের নির্বাচনী যুদ্ধের খোঁজখবর নেওয়া; স্থানীয় প্রার্থী ও সংগঠনের কর্মীদের সঙ্গে বৈঠক; চেনা মানুষ ও পূর্বপরিচিতদের কুশল সংবাদ নেওয়া এবং দেশের অন্যান্য প্রান্তের বিরোধী নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত মত বিনিময়। এছাড়াও পথে কিংবা সভামঞ্চে স্থানীয় মানুষ ও কর্মীদের সঙ্গে কথাবার্তা বলা, তাদের উপহার নেওয়া এবং তাদের সঙ্গে ছবি তোলার আবদার মেটানো তো রয়েইছে।
ঝড়ের গতিতে প্রথম পর্বের নির্বাচনী সফরের প্রায় অর্ধেক শেষ করে ফেলেছেন বাংলার মুখ্যমন্ত্রী। গত ২ তারিখ থেকে শুরু করে ১৩ তারিখ পর্যন্ত উত্তরবঙ্গে মোট ৩০টি সভা করবেন তিনি। আগামী ১৪ তারিখে ফিরবেন কলকাতায়। কারণ, সেদিন পয়লা বৈশাখ, পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন এদিনটা দিদি কলকাতাতে ফিরবেনই। ঐদিন তিনি কালীঘাটের মন্দিরে পুজো দেন। ১৫ তারিখ থেকে আবার সফর শুরু হয়ে যাবে তার। এবারের গন্তব্য মুর্শিদাবাদ মালদা।
আজ সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর ক্লান্ত শরীরে ভাবছিলাম আমাদেরই এই অবস্থা কিন্তু দিদির এই অফুরাণ প্রাণশক্তি আসে কোথা থেকে? নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই এর উত্তর পেলাম মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসাই তার শক্তির উৎস। এই ভালোবাসা ও আন্তরিকতার গুণেই তার নির্বাচনী সভাগুলি অন্য নেতাদের তুলনায় আলাদা হয়ে ওঠে। প্রতিটি এলাকার আঞ্চলিক সমস্যা সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। আসামে গিয়ে তিনি তুলে ধরেন এনআরসি ও সিটিজেনশিপ অ্যাক্ট নিয়ে বিজেপির চক্রান্ত এবং তার সমাধানে তিনি কী করেছেন তার কথা। আবার উত্তরবঙ্গে ঢুকেই তার জনসভায় উঠে আসে দীর্ঘদিন ধরে চলা ছিটমহল সমস্যার সমাধানে তৃণমূলের সাফল্যের কথার পাশাপাশি বন্ধ হয়ে যাওয়া চা বাগানগুলি না খোলার ব্যাপারে মোদি সরকারের ব্যর্থতার কথাও। কোথাও কোন অস্পষ্টতা নেই, জড়তা নেই, মানুষ তার সরাসরি কথা বলার এই ধরণটাকে পছন্দ করে। তার করেছি এবং করবো কথাটাকে বিশ্বাস করে মানুষ। বিরোধী নেতারা ঠিক এই জায়গাটাতেই তার কাছে হেরে যান। দিদির নির্বাচনী সভা শুধুই ভোট চাওয়া নয়, বরং দায়িত্ব এবং প্রতিশ্রুতি পালনের কথা মনে করিয়ে দেওয়া।
এবারের নির্বাচনী সফর আমাকে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে অন্যান্য নেতাদের একটা তুলনামূলক বিশ্লেষণের সুযোগ করে দিয়েছে। স্পষ্টই দেখছি, তার মত এত সাহস ও পরিশ্রমের ক্ষমতা বিরোধী নেতাদের নেই। তিনি যেন এক পাওয়ার হাউস। কেউ আমাকে দালাল ইত্যাদি বলতে পারেন তবুও একথাটা আমাকে বলতেই হবে। এত পরিশ্রমের মধ্যেও সকালে হাঁটা থেকে শুরু করে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথাবার্তা বলায় তার কোন ভাঁটা পড়েনি। সভামঞ্চে উঠেও দলীয় কর্মীদের সভাস্থলে কোথায় কী সমস্যা হচ্ছে তা সমাধানের ব্যাপারে নির্দেশ দেন।
আজ সকালে জলপাইগুড়ির চূড়াভান্ডার মাঠে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর সভাস্থলের আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। বিরাট মাঠ কিন্তু ঝড়বৃষ্টিতে তার অবস্থা বেশ কাহিল, বেশ কয়েক জায়গায় জল জমে আছে, জায়গায় জায়গায় কাদা। স্থানীয় মানুষরা বললেন, এসব তো কিছু দেখা যাবে না। আমি জিজ্ঞেসা করলাম কেন? উত্তর এল, মানুষ এর ওপরেই বসে পড়বেন। সত্যি তাই ঘটলো! সহজ সত্যটা এভাবেই মানুষ ঠিক বুঝতে পারেন। তাদের এই বোঝাটাই তৃণমূলনেত্রীর সবচাইতে ভরসার জায়গা। এই ভালোবাসার জোরেই বাংলার দিদি মোদি-অমিতদের মত হাঙর-কুমীরদের সঙ্গে টক্কর দিতে পারেন। এই ভালোবাসাই কয়েকদিন আগে এই মাঠেই মোদির করে যাওয়া নির্বাচনী সভার সঙ্গে দিদির সভার তফাৎ গড়ে দিল। স্থানীয় মানুষের সমস্যাকে না ছুঁয়ে সেদিন কিছু ভাসা ভাসা কথা বলেছিলেন মোদিবাবু। কিন্তু দিদি কেন্দ্রের জনবিরোধী সরকারকে ফেলে দেওয়ার ডাক দেওয়ার পাশাপাশি স্থানীয় সমস্যা সমাধানে তিনি কী করেছেন এবং করবেন তা স্পষ্টভাবে জানালেন। স্থানীয় রাজনীতির একটা সর্বভারতীয় প্রেক্ষিত তুলে ধরলেন তিনি। মানুষের উৎসাহ, জনসমাগম, বক্তব্য সবদিক থেকেই দিদির সভার সঙ্গে মোদির সভার কোন তুলনাই চলে না। শুধু অর্থ আর রাজকীয় ব্যবস্থাপনায় মোদি এগিয়ে। কিন্তু শুধু এসব দিয়ে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে লড়াই করা যায় না।
আমি জানি কোচবিহারের রাসমেলার মাঠ যেখানে আজ এক্সপায়ারি প্রধানমন্ত্রী সভা করলেন সেখানেও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর সভা করার দিন একই ঘটনা ঘটবে। এভাবেই সব চক্রান্ত, অপপ্রচারকে তুচ্ছ করে শুধু কাজ আর মানুষের ভালোবাসার জোরে সামনের দিকে এগিয়ে যাবেন বাংলার দিদি। উত্তরবঙ্গে বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর প্রতিটি সভাতেই উপছে পড়া ভিড় প্রমাণ করছে উত্তরবঙ্গে তৃণমূলের জনভিত্তি দুর্বল হওয়ার কথাটা নিছকই অপপ্রচার। ভোটের ফল বেরোনোর পর তা প্রমাণিত হবে।
নজরুলের কান্ডারী হুঁশিয়ার কবিতাটার একটা লাইন মনে পড়ে গেল আমার। বাংলার তৃণমূলনেত্রী যেন মোদীর অপশাসনের অন্ধকারাচ্ছন্ন সময়ের মধ্যে দিয়ে দেশবাসীকে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের দিকে নিয়ে চলা একটা নৌকার কান্ডারী। বিভেদ-ঘৃণা-সন্ত্রাস-কুৎসার দুস্তর পারাবার পেরিয়ে এই নৌকা তার প্রার্থিত তীরে পৌঁছবেই।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত