একুশ শতকের গোড়ায় ইনফোসিস-এর রূপকার এন আর নারায়ণমূর্তিকে প্রশ্ন করা হয়েছিল, কোন মন্ত্রের জোরে এত সফল হলেন? তাঁর স্বভাবসিদ্ধ সংক্ষিপ্ত উত্তর ছিল: প্রতিশ্রুতি কম দিয়ে তার তুলনায় কাজ বেশি করে দেখাও। মোদী সরকারের মন্ত্র ঠিক যেন উল্টো: প্রতিশ্রুতি বেশি, কাজ কম।
এত পর্যন্ত তবু ঠিক ছিল। কিন্তু ‘বাড়ি দেব, কাজ দেব, রান্নার গ্যাস দেব’ – মোদীর সব প্রতিশ্রুতি ভেসে গেল জুমলার স্রোতে। প্রতিশ্রুতি তো পূরণ হয়ইনি উল্টে একের পর এক জুমলা বাজারে ছেড়েছেন প্রধানমন্ত্রী মোদী। ২০১৯-এর ভোটের আগে সেসব পরীক্ষা করতেই এ বার দলের ওয়েবসাইটে ‘জুমলা মিটার’ চালু করল তৃণমূল। তাতে ‘মোদী যা বলেছেন’ তার একটি অংশ। তার ঠিক নীচে রয়েছে ‘সত্য’।দু’টি বিষয়ের নীচে আবার তথ্যসূত্রও দেওয়া হয়েছে। এই দুই বক্তব্যের ডান দিকে রয়েছে একটি মিটার। যার বাঁ দিকে মিথ্যা (ফলস), এবং ডান দিকে সত্য (ট্রু)।মাঝখানে একটি কাঁটা। তার দু’পাশে দু’টি আলাদা রং। নির্দিষ্ট বিভাগে গেলেই ওই কাঁটাটি ঝুঁকে পড়ছে মিথ্যা, অর্থাৎ বাঁ দিকে। কারণ, তৃণমূলের দাবি অনুযায়ী, মোদীর যে সব বক্তব্য বা প্রতিশ্রুতি তুলে ধরা হয়েছে, তার সব ক’টিই মিথ্যা। দেখে নেওয়া যাক অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে মোদীর ৫ জুমলার পরিণাম।
১। কর্মসংস্থানঃ আসল সত্য- অধিকাংশ মানুষের জীবনে মূল সমস্যা হল জীবিকার সংস্থান। মোদীর প্রতিশ্রুতি ছিল, তিনি ক্ষমতা পেলে দশ বছরে পঁচিশ কোটি চাকরি হবে। মানে, বছরে গড়ে আড়াই কোটি। গৃহস্থালির সমীক্ষার ভিত্তিতে সিএমআইই ২০১৬ সাল থেকে কর্মসংস্থানের যে হিসাব কষছে, তাতে দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালে দেশে মোট কর্মীর সংখ্যা ছিল ৪০ কোটি ৬৭ লাখ। ২০১৮ সালে সেটা কমে দাঁড়ায় ৪০ কোটি ৬২ লাখ, ২০১৯-এর ফেব্রুয়ারিতে তা ৪০ কোটিতে ঠেকেছে। সরকারি পরিসংখ্যান দেখলে, লেবার বুরো-র হিসাবে, ২০১৫-১৬ সালে বেকারত্বের অনুপাত ছিল ৩.৭ শতাংশ। জাতীয় নমুনা সমীক্ষা সংস্থার (এনএসএসও) তথ্য হিসেবে সংবাদমাধ্যমে যা প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখছি, ২০১৭-১৮ সালে বেকারত্বের হার দাঁড়ায় ৬.১ শতাংশ, গত চার দশকের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই যে, জাতীয় পরিসংখ্যান কমিশন অনুমোদন করা সত্ত্বেও মোদী সরকার এই রিপোর্টটি প্রকাশ করেনি, এবং সংস্থাটির দু’জন সদস্য এর ফলে পদত্যাগ করেছেন। এই রিপোর্টের আরও উদ্বেগজনক একটি তথ্য: শহরের তরুণদের প্রায় পাঁচ ভাগের এক ভাগ বেকার! সরকারি নথি থেকে পাওয়া এই পরিসংখ্যান দেখিয়ে দেয়, কর্মসংস্থানে মোদীর রেকর্ড শোচনীয়।
২। শিল্পঃ আসল সত্য – অদ্ভুত ব্যাপার হল, সরকারি পরিসংখ্যানে যখন জিডিপির দ্রুত বৃদ্ধি দেখানো হচ্ছে, সেই সময়েই, গত চার বছরে, কর্পোরেট মুনাফার হিসাবে মন্দা চলছে! বেশির ভাগ কোম্পানির উৎপাদন ক্ষমতার বিরাট অংশ চাহিদার অভাবে অব্যবহৃত রয়েছে। সেই কারণেই তারা নতুন বিনিয়োগে নারাজ। কলকারখানা, যন্ত্রপাতি ইত্যাদিতে বিনিয়োগের অঙ্ক ২০১৪ সালে ছিল জিডিপির ৩৪.৩ শতাংশ, ২০১৭ সালে সেটা কমে দাঁড়িয়েছে ৩০.৭ শতাংশ। ইউপিএ আমলে এই অনুপাত ছিল গড়পড়তা ৩৯ শতাংশ, মোদী জমানার গড় হল ৩১.৮ শতাংশ। পাশাপাশি, খাদ্য ছাড়া অন্যান্য ক্ষেত্রে দেওয়া ব্যাঙ্কঋণের অঙ্কও গত চার বছরে অত্যন্ত কম। সেটাও অর্থনীতির মন্দগতির পরিচয় দেয়। শিল্পক্ষেত্রে প্রদত্ত ব্যাঙ্কঋণের গতিপ্রকৃতি যদি দেখি, তা হলে ছবিটা আরও করুণ।
সংগঠিত ক্ষেত্রের বাইরে সঙ্কট গভীরতর। মাঝারি ও ছোট শিল্প (এমএসএমই) নোট বাতিলের অভিঘাত আজও সামলে উঠতে পারেনি। সিএমআইই-র হিসাবে, নোট বাতিলের পরে অসংগঠিত ক্ষেত্রে প্রায় ৩৫ লাখ মানুষ কাজ হারিয়েছেন। ‘ধর তক্তা মার পেরেক’ কায়দায় জিএসটি চালু করে দেওয়ার ফলেও সমস্যা হয়েছে।
৩। দারিদ্র ও অসাম্যঃ আসল সত্য – প্রথমত, এটা শোচনীয় ব্যাপার যে, ২০১১-১২ সালের পর থেকে দারিদ্রের কোনও সরকারি তথ্যই নেই। তবে আরও ভয়ঙ্কর হল, কোটি কোটি ভারতবাসী যখন বেঁচে থাকার জন্য কঠিন সংগ্রাম করে চলেছেন, তখন ধনীদের আয় ও সম্পদ হুহু করে স্ফীত হচ্ছে। বিশ্বের অর্থনৈতিক অসাম্য নিয়ে অর্থনীতিবিদ টমাস পিকেটি ও তাঁর সতীর্থদের তৈরি ওয়ার্ল্ড ইনইকোয়ালিটি ডেটাবেস-এর সাম্প্রতিকতম তথ্য অনুসারে, দেশের গড়পড়তা আয় ও সম্পদ যে হারে বাড়ছে, সবচেয়ে ধনী ১ শতাংশের আয় ও সম্পদ বাড়ছে তার চেয়ে অনেক বেশি হারে। আর, আয় ও সম্পদে নীচের তলার অর্ধেক মানুষের ভাগ ক্রমশই কমছে। এই বাস্তবের পাশে মোদীর ‘সব কা সাথ সব কা বিকাশ’ স্লোগান কেমন শোনায়, সেটা নিশ্চয় দেশের মানুষ জানেন।
৪। রাজকোষ পরিচালনাঃ আসল সত্য- সরকারের দাবি, জিএসটি প্রবর্তনের ফলে পরোক্ষ করদাতার সংখ্যা অনেক বেড়েছে। কিন্তু কর আদায়ের অঙ্কে অন্তত তার বিশেষ প্রতিফলন নেই। তেমনই, নোট বাতিলের ফলে অনেক বেশি মানুষ আয়কর দিচ্ছেন— এই ছিল সরকারি দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় প্রত্যক্ষ কর বোর্ডের (সিবিডিটি) তথ্যে এখনও পর্যন্ত এ দাবির বিশেষ সমর্থন মেলেনি।
৫। আয়বৃদ্ধিঃ আসল সত্য – নরেন্দ্র মোদীর অন্যতম প্রধান প্রতিশ্রুতি ছিল, দ্বিতীয় ইউপিএ জমানায় মন্দাক্রান্ত অর্থনীতির পুনরুজ্জীবন ঘটাবেন তাঁরা। বাস্তব পরিস্থিতি কী? গত ডিসেম্বরে নীতি আয়োগ, রীতিমতো অভূতপূর্ব ভাবেই, সিএসও-র ‘সংশোধিত তথ্য’ প্রকাশ করে। দেখা যায়, এর আগে জিডিপি বৃদ্ধির যে হার পাওয়া গিয়েছিল, সংশোধিত হিসাবে আয়বৃদ্ধির হার তার চেয়ে বেশি— ৭.৩ শতাংশ। ভোট আরও কাছে এল, ৩১ জানুয়ারি সিএসও নতুন সংশোধিত হিসাব প্রকাশ করল। দেখা গেল, জিডিপি বৃদ্ধির হার দাঁড়িয়েছে ৭.৭ শতাংশ! অথচ বিশ্বব্যাঙ্কের ওয়ার্ল্ড ডেভেলপমেন্ট ইন্ডিকেটরস-এর সাম্প্রতিকতম সংস্করণ অনুসারে, গত ১৫ বছরের মধ্যে মাত্র পাঁচটি বছরে ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশ ছাড়িয়েছে। এবং, সাম্প্রতিক অতীতে তিন বার ভারতের জিডিপি বৃদ্ধির হার ৭ শতাংশের নীচে নেমেছে— ২০০৮-০৯ সালের বিশ্ব আর্থিক সঙ্কটের পরে, দ্বিতীয় ইউপিএ জমানার শেষ তিন বছরে (তথাকথিত নীতিপঙ্গুতার পর্বে) এবং নরেন্দ্র মোদীর নোট বাতিলের পরের বছরে।
যিনি বলেছিলেন, মোদীনমিক্স-এর ম্যাজিক দিয়ে ভারতের অর্থনৈতিক শক্তিকে বিশ্বের দরবারে সগৌরবে প্রতিষ্ঠিত করবেন, তাঁকে এখন যদি এই বলে বড়াই করতে হয় যে, তাঁর আমলে জিডিপি বৃদ্ধির হার বছরে গড়পড়তা ৭ শতাংশ (বিশ্বব্যাঙ্কের হিসাব), কিংবা ৭ শতাংশের সামান্য নীচে (সিএসও-র আগের পরিসংখ্যান, রিজ়ার্ভ ব্যাঙ্ক হ্যান্ডবুক-এর সাম্প্রতিকতম সংস্করণে যা দেওয়া হয়েছে) অথবা মেরেকেটে ৭.৭ শতাংশ (সিএসও-র শেষ সংশোধন), তবে নিতান্ত অন্ধ ভক্ত ছাড়া আর কেউ তাঁর কৃতিত্বে মুগ্ধ হবে কি?
