দেখতে দেখতে পেরিয়ে গেছে সাড়ে ৩ বছর। কিন্তু চোখ বুজলে মনে হয় এই তো সেদিনেরই ঘটনা যেন। আদতে তা নয়। তেতাল্লিশ মাস আগে রক্তে ভেসে গেছিল যে গলিপথ, সেখানে এখন কংক্রিটের চাদর। এসেছে সৌরবিদ্যুৎ চালিত স্ট্রিটলাইট। বসেছে পানীয় জলের ট্যাঙ্ক। সেখানেই একটি ঘরের দাওয়ায় কয়েক জোড়া রং বেরঙের চপ্পলের পশরা নিয়ে বসেছিলেন ক্ষয়িষ্ণু চেহারার ষাটোর্ধ্ব এক ব্যক্তি। দরজা আগলে বসে নব্বই ছুঁই ছুঁই শাশুড়ি পুত্রবধূদের সঙ্গে গল্পে মশগুল।
এই বাড়ির ঠিক পেছনের বাড়িতেই থাকতেন মহম্মদ আখলাক। ঘরের ফ্রিজে গোমাংস রাখার ‘অভিযোগে’ বছর পঞ্চান্নর আখলাককে লাঠিপেটা করে, ইট দিয়ে থেঁতলে খুন করেছিল তাঁরই গ্রামের লোকেরা। দিল্লীর খুব কাছে পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের গৌতমবুদ্ধনগর লোকসভা কেন্দ্রে দাদরি বিধানসভা। আখলাকের গ্রাম বিশাড়া। ২০১৫ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর রাতে আখলাকের ঘরে ঢুকে তাঁর ফ্রিজ তল্লাশি করে গোমাংস খুঁজে পেয়েছিল একদল উগ্র হিন্দুত্ববাদী। তারপরেই গণপিটুনির শিকার হয়েছিলেন অসহায় আখলাক।
বিশাড়া গ্রামেই দেখা মিলল এক ‘চেনা মুখ’। বন্ধুদের সঙ্গে ক্যারম খেলায় ব্যস্ত তিনি। কে তিনি? আখলাক হত্যায় প্রধান অভিযুক্ত বিশাল রানা। দিন পাঁচেক আগেই ওঁর দেখা মিলেছিল মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের সভাস্থলে। এবং তা একেবারে সামনের সারিতে। যোগীর জয়ধ্বনি দিচ্ছিলেন বিশাল। গ্রামের আড্ডাতে তাঁর হাবভাব দেখেই বোঝা গেল, নিজের কৃতকর্মের জন্য আক্ষেপের লেশমাত্র নেই। কোনও প্রশ্ন ছুঁড়ে দেওয়ার আগেই ‘আমি কিন্তু জামিনে মুক্ত’ বলে সোজা হাঁটা দিলেন।
গোটা গ্রাম ঘুরে দেখা গেল, অনেক বাড়িতেই বিজেপির পতাকা টাঙানো। কিন্তু আখলাকের পরিত্যক্ত বাড়িটিতে গিয়ে দেখা গেল, ‘পদ্ম’-এর কোনও চিহ্নমাত্রও নেই সেখানে। সেদিনের সেই ঘটনার পরই আখলাকের ছেলে-সহ পরিবারের সবাই গ্রাম ছেড়েছেন। তবে ঠিক তার সামনের বাড়িটায় দেখা মিলল বয়স ১৫-র চনমনে পূজা শিশোদিয়ার। ‘আখলাক চাচা’র গণহত্যার সময়ে যাঁর বয়স ছিল ১২। সে ঘটনার কথা মনে আছে তাঁর। বললেন, “বছর দেড়েক আগে গ্রামে কংক্রিটের রাস্তা হয়েছে। পানীয় জলের ট্যাঙ্ক বসেছে। সৌর পথবাতি হয়েছে। আগে তো এসব ছিল না। আখলাক–কান্ডের পর করে দিয়েছে বিজেপি সরকার। একজনের ‘বলিদানে’ গোটা গ্রাম পুরস্কৃত হয়েছে।”
এরপরই রবি কাশ্যপ নামের এক যুবককে পাওয়া গেল। মর্মান্তিক গণপিটুনি ও হত্যাটিকে বিন্দুমাত্র অন্যায় বলেও মনে করেননা তিনি! তাঁর মতে, ধর্মীয় ভাবাবেগে ‘আঘাত’ হয়েছিল। হিন্দুরা প্রতিবাদ করেছিল। তাই তাদের রক্ষা করছে সরকার ও শাসক দল। এমন ‘শিক্ষা’র প্রয়োজন ছিল! তিনি এমন কথা বললেন বটে, তবে এই গ্রামেই দীর্ঘদিন ‘হিন্দু পাড়া’য় স্বচ্ছন্দে বসবাস করত একঘর মুসলিম পরিবার। জামিল খান, মহম্মদ আখলাক, জান মহম্মদ ও মহম্মদ আফজলরা চার ভাই নিশ্চিন্তে সপরিবার ছিলেন।
বাড়ি থেকে কিছু দূরে সংগ্রাম সিং ইন্টার কলেজ লাগোয়া মাঠের পাশে ছোট্ট দোকানে লোহা পিটিয়ে সরঞ্জাম তৈরি করতেন আখলাক। গ্রামের মোড়ে একটি মুদি দোকান চালান হরদীপ রাজপুত। মাঝবয়সী লোকটি আখলাকের পরিবারের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মুখ নিচু করে দুঃখের জানান দিয়ে চাপা স্বরে তিনি বলেন, ‘দোষটা আমাদেরই। গ্রামে হিন্দু-মুসলিমের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ছিল। কিন্তু, আমাদের অজান্তে ছেলেমেয়েদের মনে হিংসার বীজ বপন করা হয়েছে। এখন তা মহীরুহ।’
উল্লেখ্য, আখলাকের ঘটনাই শেষ নয়। একইভাবে গোমাংসের গুজবে হানাহানির ঘটনা ঘটেছে উত্তরপ্রদেশের বুলন্দশহরেও। গত বছরেই গো-হত্যার গুজবে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে মৃত্যু হয় এক পুলিশ ইন্সপেক্টর সুবোধ কুমার সিং-সহ দু’জনের। উল্লেখ্য, আখলাখকে গণপিটুনির ঘটনার প্রধান তদন্তকারী আধিকারিক ছিলেন এই সুবোধ সিংই।