দেশকে সবচেয়ে ভালোভাবে জানা যায় হেঁটে। গান্ধী হাঁটা আর পদযাত্রাকে তাঁর রাজনীতি ও জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে বিনোবা ভাবে বা জয়প্রকাশ নারায়ণের মত নেতারা তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেছেন। পুরনো আমলের বাম নেতাদের জীবনযাপন ও রাজনীতি থেকে জানা যায় গ্রাম থেকে গ্রাম হেঁটে যাওয়াটা তাদের কাছে কোন ব্যাপারই ছিলনা। ছোটবেলায় যখন অতিবাম রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলাম,তখনও দেখতাম দাদারা মানুষের সঙ্গে একাত্ম হওয়ার জন্য আর পুলিশের নজর এড়াতে অনেকটা পথ হেঁটে পাড়ি দিচ্ছেন।

সাংবাদিকতায় আমি যেসব নেতাদের দেখেছি তাদের সঙ্গে হাঁটাহাঁটির খুব একটা সম্পর্ক ছিলনা। অবশ্য ভোটের আগে বাড়ি বাড়ি ঘোরা আর পাড়ায় পাড়ায় পদযাত্রার একটা ব্যাপার ছিল। এখন সেসব ব্যাপারও কমেছে। কিন্তু ব্যতিক্রম আমাদের দিদি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। হাঁটা যেন একইসঙ্গে তার শরীর চর্চা, বিশ্রাম, চারপাশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হওয়া এবং জনসংযোগের একটা উপায়। ছোট মুখে বড় কথা বলছি না, বাপুর সঙ্গে তার তুলনা টানার কোন প্রশ্নই নেই তবুও দিদির সঙ্গে দীর্ঘদিন কর্মসূত্রে জড়িত বলেই জানি ভবিষ্যতে হয়তো হাঁটার ব্যাপারে তিনি একটা রেকর্ড সৃষ্টি করবেন। হাঁটাটা যেন তার একটা ব্র্যান্ড। দেশ-বিদেশ, গ্রাম-শহর, অফিস-বাড়ি সর্বত্র তিনি এই ব্র্যান্ডটি বহন করে নিয়ে চলেন। এমনকি বাকিংহাম প্যালেসের পাশ দিয়েও তিনি সাবলীলভাবে হাওয়াই চটি পড়ে হেঁটে যান। এমনটা আমি সমসাময়িক কোন রাজনীতিবিদদের মধ্যে দেখিনি।
দিদির এই হাঁটার অভ্যাসকে ঘিরে মাঝেমধ্যেই মনে ভিড় করে আসে অনেক গল্প। তার সফর সঙ্গী হয়ে একবার আছি জলপাইগুড়ির সানতালি খোলায়। খুব বৃষ্টি পড়ছে, আমরা যারা মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আছি তারা কেউই বাইরে বেরোতে পারছি না। আমরা সবাই আছি পাহাড়ের গায়ে ছোট ছোট কটেজে। টানা অতক্ষণ বসে থাকতে না পেরে ছাতা নিয়ে আমি কটেজের ক্যান্টিনের দিকে হাঁটছি, সব কটেজের দরজা বন্ধ শুধু একটা কটেজের দরজা খোলা। ভাবলাম আমাদেরই হয়তো কেউ উঠে পড়েছে। খোলা দরজার সামনে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে দিদি বলে উঠলেন, এই অশোক, এত বৃষ্টির ভেতর কোথায় যাচ্ছিস? তাকিয়ে দেখি তিনি ওই ঘরের ভেতর থেকে ব্যালকনি অবধি হাঁটছেন। কিছু বলার আগেই দিদি বলতে শুরু করলেন, জানিস, এর ভেতরেই আমি দু কিলোমিটার করে ফেলেছি, এই দ্যাখ মোবাইল। আরও দু কিলোমিটার করবো। আমার মুখে কোন কথা জোগালো না। আসলে আমরা যারা নিয়মিত দিদির সফরসঙ্গী হই তারা জানি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর কাছে দশ-পনেরো-বাইশ কিলোমিটার হাঁটা কোন ব্যাপারই না। এই হাঁটার সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে শুধু করুণ হয় আমাদের অবস্থা। নেতা, মন্ত্রী, আমলা, অফিসার, সাংবাদিক কেউই তার সঙ্গে হাঁটায় পেরে উঠিনা। যখন খবরের কাগজে কাজ করতাম তখন থেকে আজও কোন পরিবর্তন নেই। পরিমিত আহার, পর্যাপ্ত হাঁটা এই দুই অভ্যাসে তিনি যেন গান্ধীকে নিজের জীবনের সঙ্গে জড়িয়ে নিয়েছেন।
যাইহোক পরদিন আকাশ পরিষ্কার হতেই আমরা বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের গাঁ বেয়ে হাঁটা, প্রায় ১৮-২০ কিলোমিটার হেঁটে সানতালি খোলায় ফিরে চা খাচ্ছি, বিশ্ব-কিংশুক-দেবাশিস সহ অনেকেই আমরা তখন হাঁপাচ্ছি, কিন্তু দিদি নির্বিকার। মুখ্যমন্ত্রীর ওএসডি অশোক সুব্রাহ্মনিয়ম বললেন, ম্যাডাম বিকেলে আবার বৃষ্টি হবে, বেরোনো যাবেনা। দিদি বলে উঠলেন সে কি আবার বৃষ্টি, তাহলে তো হাঁটাই যাবে না। এই চলতো, সামনের ওই পাহাড়টায় উঠি, একেবারে বিকেলের হাঁটাটাও হয়ে যাবে। খুব সুন্দর চল চল, হাতে সময়ও আছে, এই বলে আমাদের কোন কিছু বলতে না দিয়ে দিদি বেরিয়ে পড়লেন। আমাদেরও তাকে অনুসরণ করা ছাড়া আর কোন উপায় রইলো না।
পাহাড়ের গা বেয়ে প্রায় তিন হাজার কিলোমিটার খাড়াই রাস্তা উঠে গেছে, ফরেস্ট গার্ড সহ আমরা উঠতে লাগলাম। মিনিট কুড়ি হাঁটার পর সবারই প্রাণ বেরিয়ে যাওয়ার মত অবস্থা। সামনে তাকিয়ে দেখি দিদি আমাদের থেকে প্রায় দশ মিনিট দূরত্বে স্থানীয় কিছু লোকেদের সঙ্গে দিব্যি গল্প করতে করতে ওপরে উঠে যাচ্ছেন, পায়ে সেই চেনা চটি। পাহাড়ের রাস্তায় হাওয়াই চটির মত একটা ব্যাপারকে তিনি কীভাবে সামলাচ্ছেন তা ভাবতেও আমার অবাক লাগছিল। আমাদের অবস্থা দেখে দিদিও মাঝেমধ্যে দাঁড়িয়ে পড়ছিলেন। শুধু আমরা নয়, ফরেস্ট গার্ড সহ অনেক পুলিশেরও আমাদের মত অবস্থা। একটু ওপরে দেখা যাচ্ছে একটা ছবির মত ফরেস্ট বাংলো, তিনটি ঘর, মনোরম দৃশ্য।
বাংলোর সামনে দিদি একটা চেয়ারে বসলেন। আমায় বললেন, আমার ছবি না তুলে জায়গাটার কিছু ভালো ছবি তোল। বনদপ্তরের দু তিনজন কর্মীর ওই বাংলোর আশেপাশে নিজেদের পরিবার নিয়ে থাকেন। আমরা গাড়ি ছাড়া অতটা খাড়াই রাস্তা হেঁটে উঠেছি শুনে এক বৃদ্ধ তো বলেই দিলেন আপ লোগ পাগল হ্যায়। যখন বললাম, উনি আমাদের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তখন ওরা শুধু হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন। আমরা চা, বিস্কুট খেয়ে একটু জিরিয়ে নিতে নিতে ভাবছি, এতটা রাস্তা আবার হেঁটে নামতে হবে। আমাদের মধ্যে তখন আলোচনা চলছে দিদিকে একটা গাড়ি ডেকে নেওয়ার জন্য কে বলবে? আমরা তো আর পারছি না। হঠাৎ দিদি নিজেই পিএসও স্বরূপ দ্বিবেদীকে নির্দেশ দিলেন, গাড়িগুলো ডেকে নাও। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।
দেশ বিদেশ যেখানেই যান না কেন দিদি হাঁটবেনই। এখন গ্রামের মানুষরাও জেনে গেছেন দিদি যে কোন সময় হেঁটে তাদের গ্রামে চলে আসতে পারেন। অনুষ্ঠান শেষে ফেরার সময় ১০-১৫ কিলোমিটার আগে গাড়ি ছেড়ে দিয়ে হাঁটতে থাকেন। সুকনা ফরেস্ট বাংলো থেকে মহানন্দা পর্যন্ত হেঁটে জলে নেমে হাত মুখ ধুয়ে ফিরে আসা তার কাছে কোন ব্যাপারই নয়।
আমি জানি, হাঁটা মানেই দিদির জনসংযোগ। যেখানেই তিনি ওঠেন সেখানে সকাল হলেই তিনি বেরিয়ে পড়েন মানুষের সঙ্গে কথা বলতে, চলে যান গ্রামে। স্কুলের মিড ডে মিলের মান কেমন তা জানতে নিজেই তা খেয়ে দেখেছেন, এমনকি চিফ সেক্রেটারিকেও খাইয়েছেন। মানুষের সঙ্গে কথা বলতে বলতেই তিনি জেনে নেন ছাত্রছাত্রীদের কেন সাইকেল নেই? তাদের পায়ে জুতো নেই কেন? পুকুরের জল কখন শুকিয়ে যায় এমন সব জরুরি অথচ সাধারণ তথ্য। গ্রাম বাংলার মানুষের নাড়ির গতি ধরতে পারেন বলেই তিনি নেত্রী হিসেবে সফল।
কিছুদিন আগে এই সময় কাগজে গান্ধীর হাঁটার কথা পড়তে পড়তে আমার দিদির কথা মনে পড়ছিল। এটাকে কেউ তুলনা মনে করবেন না, গান্ধীর সঙ্গে কারোর তুলনা অনুচিত। কিন্তু এটাও ঘটনা অবিরাম হাঁটা আর রাতে চিড়ে ভাজা, ছোলা, মুড়ি খেয়ে শুয়ে পরা দিদির জীবনযাপনের সঙ্গে কোথাও একটা বড় মিল আছে। এই মিলই তাকে দেশের অন্য সব রাজনীতিবিদদের থেকে আলাদা করে তুলেছে।
আমার মনে হয়, হাঁটতে হাঁটতে তিনি স্পর্শ করছেন জীবন, বুঝছেন দেশের মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষা। আর মানুষও দেখছে গাড়ি নয়, প্লেন নয়, আমলা নয়, রক্ষী নয়, নেতা নয় এই মহিলা সরাসরি তাদের কাছে চলে আসতে পারেন। হাঁটাটাই তার আসল কানেক্ট। গান্ধীর মত অগ্রজ রাজনীতিবিদরা দেশকে হেঁটে দেখতে শেখার যে শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিলেন, হাঁটাকে যেভাবে তারা প্রতিবাদের বাহন করে তুলেছিলেন সেই শিক্ষাকে তিনিই প্রকৃত আত্মস্থ করতে পেরেছেন বলেই দেশের আর পাঁচজন রাজনীতিবিদদের থেকে তিনি আলাদা।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত