দেশবাসীকে একাধিক ‘জুমলা’ দিয়ে ক্ষমতায় এসেছিলেন তিনি। ‘আচ্ছে দিন’-এ ফেরি করেছিলেন ‘স্বচ্ছ ভারত’-এর স্বপ্ন। সেই মতোই স্বচ্ছ ভারত অভিযানে হাত দিয়েছিল মোদী সরকার৷ লক্ষ্য ছিল ২০১৯-এর ২ অক্টোবরের মধ্যে দেশে খোলা জায়গায় শৌচ পুরোপুরি বন্ধ করা। পাঁচ বছর পেরিয়ে সামনে আরও এক লোকসভা নির্বাচন। বহু চর্চিত স্বচ্ছ ভারত অভিযানের রিপোর্ট মোটেই স্বস্তি জনক নয়।
তথ্য অনুযায়ী মোদী সরকারের বিরাট বিজ্ঞাপন চর্চিত ঝলমলে প্রচার হলেও এখনও দেশের ৪০ শতাংশ মহিলা শৌচাগার ব্যবহার করেন না। এটাই কড়া বাস্তব৷ ২০১৭ সালে রাষ্ট্রসংঘের বিশেষ দূত লিও হেলার মোদীর স্বচ্ছ ভারত অভিযান নিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন। শৌচাগার তৈরি হলেও পর্যাপ্ত জলের অভাবে আট থেকে আশি বেশিরভাগ গ্রামাঞ্চলের মানুষ মাঠে গিয়েই শৌচ-ক্রিয়া করছেন এমন তথ্য দিয়েছিলেন তিনি। নমো সরকারের স্বচ্ছতা সচেতনতা নিয়ে চেষ্টার অভাব রয়েছে তা স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন।
অথচ শতাব্দী প্রাচীন এই ধারণাটি প্রথম শুরু করেছিলেন গান্ধী৷ ১৯০১ সালে গান্ধীজি কলকাতায় কংগ্রেসের অধিবেশনে বিরাট সংখ্যক কর্মীদের মল-মূত্র পরিষ্কারের কাজটি নিজে হাতেই শুরু করেছিলেন৷ দেশকে স্বচ্ছ করার জন্য তিনি নিজের হাতে তুলে নিয়েছিলেন ঝাঁটা, পরিষ্কার করেছিলেন বর্জ্য। অশিক্ষার আঁধারে ঢাকা পরাধীন দেশবাসীকে বারবার স্বচ্ছতার শিক্ষাও দিয়ে গেছেন তিনি। কিন্তু ঝলমলে বিজ্ঞাপনের আড়ালে এই ঐতিহাসিক কর্মসূচির কথা চাপা পড়ে গেছে৷
প্রসঙ্গত, ১৯০১ সালের কংগ্রেস অধিবেশন বসে কলকাতায়৷ তৎকালীন রিপন কলেজে (এখনকার সুরেন্দ্রনাথ কলেজ) অনুষ্ঠিত হয় সেই অধিবেশন৷ সেখানে তিনি সাধারণ কংগ্রেস প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন৷ অধিবেশন স্থলে শৌচাগারের অবস্থা দেখে মনখারাপ হয় তাঁর৷ বুঝতে পারেন এই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ থেকে মহামারি ছড়ানোর সম্ভাবনা প্রবল৷ সেইসঙ্গে তিনি দেখেন, বেশিরভাগ অতিথিরাই ঘরের কাছেই বারান্দার কোণে গিয়ে মূত্রত্যাগ করছেন।
বেশিক্ষণ এই দৃশ্য সহ্য করতে পারেননি তিনি। অবশেষে স্বেচ্ছাসেবকদের অভিযোগ করেন। এলাকা পরিষ্কার করার কথা বলেন। কিন্তু সেই স্বেচ্ছাসেবকরা তাঁকে বলেছিল, এসব তাদের কাজ নয়। এই কাজ ঝাড়ুদারদের। উত্তর শুনেই অপেক্ষা না করে নিজেই হাতে তুলে নেন ঝাঁটা। বর্জ্য পরিষ্কার করতে শুরু করে দেন। স্বেচ্ছাসেবকরা ঘটনা দেখে হকচকিয়ে যান৷ কিন্তু সংস্কার ছিন্ন করে সেই কাজে হাত বাড়িয়ে দিতে কেউ এগিয়ে আসেননি। একলা গান্ধী শুরু করলেন স্বচ্ছ অভিযান৷
তখন তিনি সদ্য দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে দেশে ফিরেছেন। বিদেশে দেখে এসেছেন অপরিষ্কার , অচ্ছুত হিসাবে কিভাবে ভারতীয়দের উপর অত্যাচার করার ঘটনা৷ ঐতিহাসিকদের মতে, মহাত্মা সেদিনই বুঝেছিলেন ভারতের এই সমস্যা সমাধান করতেই হবে। পরে তাঁর উদ্যোগে জাতীয় কংগ্রেসের মধ্যেই স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ‘ভাঙ্গি’ বা ঝাড়ুদারের দল গঠন করা হয়। একসময় সেই দলে কাজ করত ব্রাহ্মণরাই।
শুধু তাই নয়। এরপর তাঁর নেতৃত্বে হরিপুরা কংগ্রেসে ২০০০ জন শিক্ষক ও ছাত্রদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল বর্জ্য সাফ করার জন্য। যখনই সুযোগ পেয়েছেন নিজে হাতে বর্জ্য সাফ করেছেন। তিনি বলতেন, ‘আমি যদি ঝাড়ুদার হিসাবে মরতে পারি তাহলে সবথেকে সুখী হব।’ তারপর পেরিয়ে গেছে ১২০ বছর। এরমধ্যে ভারত অনেক এগিয়েছে। শিক্ষিতের সংখ্যাও বৃদ্ধি পেয়েছে। মানুষের জীবনযাত্রার ধরন বদলেছে৷ গান্ধীর সেই স্বচ্ছতা অভিযান এখন কর্পোরেট মোড়কে মুড়ে গিয়েছে৷
উল্লেখ্য, এখনও দেশে পর্যাপ্ত শৌচালয় নেই। কোথাও কোথাও আবার শৌচালয় থাকলেও নেই জল। ফলে এখনও বহু প্রত্যন্ত গ্রামের মানুষদের ভরসা করতে হচ্ছে মাঠঘাটের ওপরই। অথচ সরকারের প্রচার দেখলে মনে হয় স্বচ্ছ ভারত অভিযান হিট! আসলে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতেই এখন শৌচালয় তৈরির চেয়ে ব্যানার-হোডিং তৈরিতেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে মোদী সরকার।