মোদি শুধু নেতা নন, প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর থেকে নিজেকে তিনি বারবার অভিনেতা প্রমাণ করে ছেড়েছেন। কখনও তিনি অবতীর্ণ হয়েছেন চাওয়ালার ভূমিকায়, কখনও সাজছেন চৌকিদার! পুলিশের জমানায় চৌকিদার শব্দটাকে আমরা প্রায় ভুলতে বসেছিলাম। আইনশৃঙ্খলা রক্ষকদের এই পুরনো নামটাকে তিনি আবার মনে করিয়ে দিয়েছেন। বিরোধীদের কটাক্ষের জবাবে মোদি বলছেন, ম্যয় ভি চৌকিদার। ভাল কথা, কিন্তু এই চৌকিদারের জমানাতেই দেশ থেকে নীরব মোদি, মেহুল চোকসীদের মত বাটপাড়রা কোটি কোটি টাকা তছরুপ করে দেশ থেকে পালিয়েছে। এই চৌকিদারের আমলেই রাফাল কেলেঙ্কারি হয়েছে। কৃষকদের আত্মহত্যাই বা তিনি রুখতে পারলেন কোথায়?
চৌকিদারের ওপর ভরসা রাখা দেশের গরিব ও মধ্যবিত্ত মানুষদের এই আমলেই ডিমনিটাইজেশনের নামে রাতারাতি সর্বস্বান্ত করে দেওয়া হয়েছে। অভিযোগ উঠেছে কালো টাকা উদ্ধারের নামে এটা গরিবদের ভাতে মারার ব্যবস্থা। কাজেই মোদি নামক চৌকিদারের ওপর দেশের মানুষ আর ভরসা করতে পারছেন না। মুখে নিজেকে চৌকিদার বললেও প্রকৃত চৌকিদারের ভূমিকা পালন করতে ব্যর্থ হয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু মোদির সমালোচনা করতে গিয়ে কংগ্রেস চৌকিদার চোর হ্যায় নামে যে স্লোগান তৈরি করেছে তাতে সাধারণভাবে সব চৌকিদারকেই অপমান করা হয়েছে বলে আমার মনে হয়।
অনেকদিন গালমন্দ হজম করার পর বিজেপির প্রচারবিদরা মোদির মুখে বসিয়ে দিয়েছেন পাল্টা এক নতুন বাণী ম্যয় ভি চৌকিদার। এই স্লোগানটা জনপ্রিয় করার জন্য প্রধানমন্ত্রী তার সব মিটিং এ বারবার ম্যয় ভি চৌকিদার কথাটা থেকে থেকে আউরে চলেছেন। রাজনৈতিক ওতোরচাপানে চৌকিদার কথাটা আচমকা একটা গুরুত্ব পেয়ে গেছে। দেশের দর্শক শ্রোতারা কথাটা যে বেশ পছন্দ করেছেন তা হাটে মাঠে ঘাটে ঘুরলে বেশ বোঝা যায়। আমার প্রশ্নটা অন্য জায়গায়, আমার মনে হয় চৌকিদার শব্দটাকে নিয়ে এত কদর্য টানাহ্যাঁচড়া করা হচ্ছে যে শব্দটা গুরুত্ব হারাচ্ছে।
আমার মনে হয় চৌকিদার কথাটাকে এভাবে রাজনৈতিক তরজার সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার ফলে এই পেশাটাকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। স্রেফ রাজনৈতিক বাকবিতণ্ডার কারণে একটা বিশেষ পেশার লোকেদের কি চোর বলে দেগে দেওয়া যায়? আইনশৃঙ্খলার রক্ষকদের চোর বলে দেগে দিলে মানুষের কী আইন নামক ব্যবস্থার ওপর আস্থা থাকবে? চোর বলে একটা পেশাকে দেগে দিলে মানুষ কী ভরসা করতে পারবেন সেই পেশার ওপর? মানুষ একসময় নিজেদের ধন, প্রাণ, মান এবং আইনশৃঙ্খলার সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য একজন নির্ভরযোগ্য চৌকিদার খুঁজতেন। সিনেমা, থিয়েটার, সাহিত্যে এভাবেই আমরা নানাধরণের চৌকিদার চরিত্রের দেখা পেয়েছি। কিন্তু রাজনীতিবিদদের ভুল তাকে সরাসরি ভিলেন বানিয়ে ছাড়লো।
আমার মনে হয় কংগ্রেস থুড়ি রাহুল চৌকিদার চোর হ্যায় বলে যে স্লোগান তৈরি করেছেন তাতে চৌকিদারকে চোর বানিয়ে একটা পেশাকে ছোট করা হচ্ছে। অন্যদিকে তার পাল্টা হিসেবে মোদি ম্যয় ভি চৌকিদার বলে যে আওয়াজ তুলেছেন তাতে এমন একটা ধারণা তৈরি করা হচ্ছে যে চৌকিদার হওয়াটা যেন খুব একটা সহজ সরল ব্যাপার, যে কেউ তা হতে পারেন, এজন্য কোন যোগ্যতা লাগেনা। এভাবে একটা পেশাকে গুরুত্বহীন ও হাস্যকর করে তোলা হচ্ছে। যে কোন পেশার জন্যই একটা ন্যুনতম যোগ্যতা লাগে। সাহস, নিষ্ঠা, বুদ্ধি, কাণ্ডজ্ঞান চৌকিদারের সম্পদ। দুটোই ভুল, বিজেপি ও কংগ্রেস চৌকিদারকে নিয়ে এই টানাহ্যাঁচড়া বন্ধ করলে আর কারো না হোক রাজনীতির উপকার হবে।
রাজনীতিবিদদের সম্পর্কেও অনেকে ভাসা ভাসা ভাবনা থেকে নানা ধরণের কথাবার্তা বলে দেন। কেউ তাদের বলেন দুর্নীতিগ্রস্থ, কেউ বলেন ধান্দাবাজ। তাদের নিশ্চয়ই তা ভালো লাগেনা। তাহলে চৌকিদারদের সম্পর্কে মোদি বা রাহুল এমন কথা বলছেন কেন? কাউকে সমালোচনা করার নামে কোন পেশাকে অকারণে ছোট বা বড় করার অধিকার কারোর নেই, তা তিনি যত বড় রাজনীতিবিদই হোন না কেন।
মনে রাখবেন চৌকিদার নামক পেশাটার গায়ে রাজনীতিবিদরা যে বিশেষণই সেঁটে দিন না কেন তা কিন্তু মানুষ এক নিমেষে তুলে ফেলতে পারেন। রাজনীতিবিদদের দেখে মানুষ তেমন কিছু বললে তখন তারা তা সহ্য করতে পারবেন তো? যে যত বড় রাজনীতিবিদই হোন না কেন কোন পেশাকে ছোট করার অধিকার কারো নেই। মোদি এবং রাহুল দুজনকেই মাথায় রাখতে হবে স্লোগানে চমক সৃষ্টি করা গেলেও সব চৌকিদার চোর নয়, আবার সবাই ইচ্ছা করলেই চৌকিদার হয়ে যেতে পারেন না। কাজেই এমন অর্থহীন কথা না বলাই ভালো।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত