নুসরত আর মিমির নাম প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পর থেকেই বাংলার পল্লীসমাজ এ যেন নিন্দা আর কুৎসার বান ডেকেছে। অথচ এ সমাজ নিয়মিতভাবে পালন করে নারীদিবস, কথায় কথায় তোলে নারীমুক্তির স্লোগান কিন্তু ভেতরে ভেতরে তারা যে শরৎচন্দ্রের �পল্লীসমাজ� এর আমলেই পড়ে রয়েছে তা এদের মন্তব্য, বক্তব্য এবং সোশ্যাল মিডিয়াতে এদেরকে ট্রোল করা দেখলেই বোঝা যাচ্ছে। সিপিএম ও বিজেপি সমর্থকদের কুৎসিত মন্তব্য নিয়ে আমি কিছু বলছি না। এদের থেকে এর বেশি আশা করাও ভুল। কিন্তু আমি অবাক হলাম রাজ্যের বামকুল চূড়ামণি সূর্যকান্ত মিশ্রের বক্তব্য দেখে! সূর্যবাবু এমনিতে ভদ্র, পেশায় ডাক্তার ও উচ্চশিক্ষিত মানুষ তবু তিনিও তার দলের অন্যান্যরা তাদের হাঁটুর বয়সী দুটি মেয়ের প্রার্থীপদ নিয়ে কেন এত কুচ্ছো গাইছেন তা বোঝা কঠিন!

গণতান্ত্রিক দেশে সাংবিধানিক স্বীকৃতি অনুযায়ী দুজন শিক্ষিত মেয়ে প্রার্থী হয়েছেন। দুজনেই পেশায় অভিনেত্রী, বাংলার সাংস্কৃতিক মহলে পরিচিত নাম। এদের বিরুদ্ধে কোন ফৌজদারি অভিযোগও নেই। তাহলে এরা প্রার্থী হওয়াতে অন্যায় কোথায়? বাংলার �পল্লীসমাজ� এর পাণ্ডারা বলবেন, এদের পোশাকআশাক দৃষ্টিকটু। আমার প্রশ্ন, আপনারা কি আপনাদের পাড়ার বা পরিবারের কমবয়সী মেয়েদের পোশাকআশাকের দিকে তাকিয়ে দেখেছেন? অনেকের বাড়ির মেয়ে, নাতনি, পুত্রবধূরা তো এখন এমন জামাকাপড়ই পড়েন? তাহলে এদের অন্যায়টা কোথায়? আমি জানি পরবর্তী প্রশ্নটা হবে এরা সিরিয়াল, সিনেমায় অভিনয় করেন? সেখানে অশ্লীল জামাকাপড় পড়ে শরীর দেখান? সবিনয়ে একটা প্রশ্ন করি, ছবি, সিরিয়াল সবকিছুতেই শ্লীলতা, অশ্লীলতার একটা মাপকাঠি থাকে। সেটা না মানলে তা প্রদর্শন করার ছাড়পত্র পাওয়া যায়না। তাদের পোশাক সেই ছাড়পত্র পেয়েছে বলেই আপনারা তা দেখে সমালোচনা করতে পারছেন। কাজেই অশ্লীলতার অভিযোগও ধোপে টিঁকছে না।
সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখলাম কেউ কেউ বলছেন, সংসদ, রাজনীতি একটা সিরিয়াস ব্যাপার, সেখানে অভিনেত্রীরা কী করবেন? তাদের সবিনয়ে মনে করিয়ে দিতে চাই বিগত কয়েক বছরে সর্বভারতীয় ক্ষেত্রে সংসদে অভিনেত্রীদের পারফর্মেন্সের দিকে তাকান, তারপর মন্তব্য করবেন। আমি কিন্তু শুধু কোন বিশেষ দলের সাংসদদের কথা বলছি না। মুশকিল হল কুয়োর ব্যাঙরা কোনকিছুরই খোঁজখবর রাখেন না। তাহলেই দেখতে পেতেন বিভিন্ন দলের মহিলা সাংসদরা সভায় প্রশ্ন তোলা, বিতর্কে অংশগ্রহণ করা, সংসদ তহবিলের টাকা খরচ করা, আপদে বিপদে এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়ানো ও তাদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখা ইত্যাদি বহু দায়িত্বই অত্যন্ত যোগ্যতার সঙ্গে পালন করেছেন। তাহলে এই প্রশ্ন আসছে কেন? এটা আসছে এই কারণেই তা হল প্রশ্নকর্তারা মধ্যযুগীয় আমলে পড়ে রয়েছেন। তারা রান্নাঘর আর হারেম ছাড়া মেয়েদের আর কোথাও দেখার জন্য মানসিকভাবে তৈরি নন। কাজ নয়, মেয়েরা তাদের কাছে শুধুই একটা দর্শনীয় বস্তু।
অনেকে দেখলাম মন্তব্য করেছেন যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়, কবীর সুমন, সুগত বসু, বিকাশরঞ্জন ভট্টাচার্যের মত ওজনদার প্রার্থীরা লড়াই করেছেন। সেখানে মিমি চক্রবর্তী! আমার মনে পড়ছে, তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যখন যাদবপুরে প্রয়াত সোমনাথদার বিরুদ্ধে প্রার্থী হলেন তখন বামেরা রব তুলেছিলেন, এটা কোন প্রার্থী হল? খবরের কাগজ ও টিভিতে প্রচার হয়েছিল দুঁদে ব্যারিস্টার সোমনাথ চট্টোপাধ্যায়ের সামনে টালির চালের বাড়ির এই লড়াকু মেয়েটা দাঁড়াতেই পারবে না। বেশ মনে পড়ছে সেসময় আমাদের দিদির বিরুদ্ধেও নানারকম নিন্দা ও কুৎসার বান ডেকেছিল।
আমি জানি নুসরত, মিমির ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটবে। সব বিরোধিতা উড়িয়ে দিয়ে বসিরহাট ও যাদবপুর দুটি কেন্দ্রেই জয়ী হবেন তৃণমূল প্রার্থীরা। এটা কোন দৈবিক ব্যাপার নয়। পরিশ্রম ও কাজই এদের সাফল্য এনে দেবে। দুজনেই পরিশ্রমী, আন্তরিক, শিক্ষিত, মানুষের সঙ্গে মিশতে পারেন, তাদের জন্য কাজ করতে চান, শেখার ইচ্ছা আছে � জনপ্রতিনিধিদের এর থেকে বেশি যোগ্যতা লাগে বলে আমার জানা নেই। এদের সম্পর্কে আমি এত কথা বলছি তার কারণ, অভিনয়ে আসার গোড়ার দিক থেকেই এদের আমি চিনি। নুসরতের সঙ্গে ঋতব্রত ভট্টাচার্য পরিচালিত �সন্ধ্যা নামার আগে� ছবিতে অভিনয় করেছিলাম আমি। মিমির কাজকর্মের সঙ্গেও পরিচিত। দুজনের সঙ্গেই মাঝেমধ্যেই কথাবার্তা হয়। সুযোগ, উৎসাহ পেলে এরা ব্যর্থ হবেন কেন? তাছাড়া একটা দল এদের ভোটে প্রার্থী করেছে, তাতে আপনাদের সমস্যাটা কোথায়? �
আমরাই বলি পরবর্তী প্রজন্মকে রাজনীতিতে আনার কথা। কারণ, এতে রাজনীতি ও দেশ দুটোই চলমান থাকে। তাহলে দুই নবীনার প্রার্থী হওয়াতে আপত্তি উঠছে কেন? এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম অদ্ভুতভাবে! আর যার কাছ থেকে পেলাম �পল্লীসমাজের� পণ্ডিতদের এই প্যাঁচালো প্রশ্নের উত্তর তিনি এত সহজভাবে দেবেন তা আমিও আশা করিনি। গতকাল বিকেলে কথা হচ্ছিল আমার মার সঙ্গে। এই প্রসঙ্গ তুলতেই মা যা বললো তা হুবহু তুলে দিচ্ছি কি সুন্দর মেয়েদুটোকে দেখতে। ওদের সিনেমা আমি টিভিতে দেখেছি। তোরা মেয়েরা কিছু করলেই আজেবাজে কথা বলিস। দেখবি ওরা ঠিক জিতবে। মমতাকে নিয়েও তোরা অনেক কথা বলেছিলি।
আমার মা শ্রীমতি অর্চনা মজুমদার এসেছিলেন সাবেক পূর্ব পাকিস্তান এখন বাংলাদেশ থেকে। পড়াশুনা ক্লাস থ্রি পর্যন্ত। খবরের কাগজ পড়তে পারেন না, টিভি দেখেন। জীবনে ইন্দিরা গান্ধী ছাড়া আর কোন মহিলা নেত্রীর নাম মা জানতেন না, তিনি কোন দলের তাও মা বলতে পারতেন না। মা ইন্দিরা গান্ধীকে পছন্দ করতেন শুধু তিনি দেখতে সুন্দর বলে। অথচ এই মা টিভিতে দিদির আন্দোলন, প্রতিবাদ ও তার ওপর পুলিশের অত্যাচারের ছবি দেখে আমাকে বলেছিলেন � মেয়েটার দারুণ সাহস, দেখিস এ অনেক দূর যাবে। সেই মেয়েটাই আজকে আমাদের দিদি, বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। মা�র একটা অদ্ভুত দেখার চোখ আছে, যা বলে তা মিলে যায়। মা�র কাছেই আমার আধুনিকতার প্রথম পাঠ। সাধারণ মানুষদের দেখার এই অসাধারণ চোখের প্রমাণ আমি নিজেও জীবনে বহুবার পেয়েছি। তারাই বুঝতে পারেন দেশের মানুষের মনের কথা। নারীশক্তি আজ পৃথিবী জুড়েই একটা বাস্তবতা। বাংলার সবজান্তা �পল্লীসমাজ�কে এই বাস্তবতা বুঝতে হবে। স্বীকৃতি জানাতে হবে সমাজ গড়ার কাজে মেয়েদের ভূমিকা ও কাজকে, নাহলে ভোট কেন, কোন লড়াইতেই তারা জিততে পারবেন না।
নুসরত ও মিমির প্রতি আমার ভালবাসা, অভিনন্দন এবং শুভেচ্ছা রইলো।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত