সে প্রায় এক যুগ আগের কথা। এক দামাল কণ্ঠ গেয়ে উঠল, “এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই…শেষ পর্যন্ত আমি তোমাকে চাই”। বাঙালিকে প্রেমে ডুব দিতে শেখালো এই গান। চিরাচরিত ভাবে ভালবাসার কথা বলার বদলে এভাবে আকুল করে নিজেকে সমর্পণ করতে শেখানো মানুষটি হলেন কবীর সুমন। প্রেম, বিচ্ছেদ, নিদ্রাহীন রাতে যিনি বছরের পর বছর মানুষের সঙ্গী হয়েছেন, আজ তাঁর জন্মদিন।
তার অনেক পরিচয়। একজন বাঙালি গায়ক, গীতিকার, অভিনেতা, বেতার সাংবাদিক, গদ্যকার এবং রাজনীতিক কবীর সুমন। তার আরো একটি পরিচয় দিতে ভালোবাসেন। সেটি হলো তিনি যোদ্ধা। এই যুদ্ধ তার শ্রেণি বৈষম্যের বিরুদ্ধে, এই যুদ্ধ তার অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে, এই যুদ্ধ তার শুদ্ধ গানের চর্চায়, এই যুদ্ধ মানুষের মনুষত্ব নিয়ে টিকে থাকার আহ্বানে।
কবীর সুমন ১৯৪৯ সালের ১৬ মার্চ ভারতের উড়িষ্যায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পূর্ব নাম সুমন চট্টোপাধ্যায়। তার পিতা সুধিন্দ্রনাথ এবং মাতা উমা চট্রোপাধ্যায়। বাংলাদেশের কিংবদন্তি গায়িকা সাবিনা ইয়াসমিনকে বিয়ে করার জন্য ২০০০ সালে ধর্মান্তরিত হয়ে নিজের নাম নিজেই রেখেছিলেন কবীর সুমন। প্রথম জীবনে রেডিও জার্নালিস্ট হিসেবে কাজ করেছেন ডয়েচ ভেলে তে,কাজ করেছেন অল ইন্ডিয়া রেডিওতে। কেরানী ছিলেন ইউনাইটেড ব্যাঙ্ক অব ইন্ডিয়াতে। বন্ধু অঞ্জন দত্তের অনুরোধে অভিনয় করেছেন ‘রঞ্জনা আমি আর আসবো না’ সহ কিছু ভারতীয় বাংলা সিনেমাতেও। সৃজিতের ‘জাতিস্মর’ ছবিতেও মিলেছে সুমনের উপস্থিতি।
যেখানে অন্যায়, সেখানেই সুমনের প্রতিবাদ। মানুষ হিসেবে তিনি আগাগোড়া অসাম্প্রদায়িক। লালন সাঁই তার আত্মার মন্দিরে থাকেন। বাংলাদেশের প্রতি সুমনের প্রাণের টান ফিকে হয়ে যায়নি কখনো। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চ থেকে ফেলানী-হত্যার বিচার, রাজাকার বিরোধী আন্দোলনের সময় খুন হওয়া ব্লগার রাজীব হত্যার বিচার, নন্দিত লেখক হুমায়ূন আহমেদের মৃত্যুর পর তাকে নিয়ে গান করাসহ বাংলাদেশের বহু প্রসঙ্গ নিয়েই সুমন গান করেছেন।
তবে জন্মদিন নিয়ে বাড়তি আবেগ বা আদিখ্যেতার স্রোতে হাবডুবু খাননি সুমন। যদিও আজ একাত্তরে পা রাখার মুহূর্তে সটান এটা বলতেও তিনি কুন্ঠিত নন যে, পরের জন্ম থাকলে এই মায়ের কোলেই ফিরতে চান তিনি। সুমন বললেন, “আমার আয়ু যদি মামাদের মত হয়, তা হলে আমার সময় ফুরিয়ে এল। আর কটা বছর মাত্র। বাবাদের আয়ু পেয়ে থাকলে আশি-একাশি অর্থাৎ আর বছর দশেক”।
মৃত্যু আমাদের সকলের জীবনে আবশ্যিক। সকলকেই সেই অধ্যায়ের মুখোমুখি হতে হবে। তবে আজ না হয় সেই ভাবনা দূরে থাক। সুমন ডুবে থাকুন তাঁর সৃষ্টিতে, তার গানে, তার নিজস্বতায়। এভাবেই কেটে যাক দিনগুলো তার গানে গানে। তার ভক্তরা সবাই জানেন, কবীর সুমনের অনেক অভিমান। সমাজ নিয়ে, দেশ নিয়ে, রাজনীতি নিয়ে, বিশ্বনীতি নিয়ে, প্রেম নিয়ে, প্রেমের স্বাধীনতা নিয়ে, সুন্দর আর নিজস্ব গান করা নিয়ে। সবাই অভিমান করতে পারে না। কবীর সুমন অভিমান নিয়েই বেঁচে থাকুন। এইসব অভিমান তাকেই মানায়। এইসব অভিমান তাকে মহান করেছে, নন্দিত করেছে।