আমার মোটা মাথায় সোজাসাপটাভাবে এ কথাই মনে হয় যে ভোট হল, দেশের মানুষ ভবিষ্যতে কেমন থাকবেন, কীভাবে তিনি আরও বিকশিত হতে পারেন তা ঠিক করার লড়াই। ভোট হল, অতীতের কথা না ভেবে ভবিষ্যতের কথা ভাবার সময়। তাই আমি বাংলার কবি-সাহিত্যিক-গায়ক-অভিনেতা-চলচ্চিত্রকার-নাট্যকার-শিল্পী-কার্টুনিস্ট-বুদ্ধিজীবী, বন্ধু, দাদা, ভাইবোনেদের অনুরোধ করবো আগামী দুমাস ভূতের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে মানুষের ভবিষ্যতের কথা ভাবুন, অন্তত সেটাকে গুরুত্ব দিন। আপনাদের অনেকের সঙ্গে আমার দীর্ঘ কয়েক দশকের সম্পর্ক। আপনাদের জ্ঞান দেওয়ার ধৃষ্টতা, সাহস, ইচ্ছা কোনটাই আমার নেই। আপনারা সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে কীর্তিমান। তবুও সামান্য ফোটোওয়ালার এই আবেদনটুকু ভেবে দেখবেন, নিজেদের বিচার বিবেচনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেবেন।

কাকে ভোট দেবেন বা দেবেন না সেটা একান্তই আপনাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু এই নির্বাচনী যুদ্ধের প্রাক্কালে মন খুলে বলুন নিজের মতামত। স্পষ্ট করে জানান তৃণমূল ক্ষমতায় আসার পর রাজ্যের উন্নতি হয়েছে কি হয়নি? বলুন বিজেপির আমলে দেশ এগিয়েছে না পিছিয়েছে? আপনারা তো আপনাদের সৃষ্টিকর্ম, মতামত দিয়ে মানুষের জীবনকে সমৃদ্ধ করেন, পথ দেখান তাদের। ভূতের ভবিষ্যতের কথা ভেবে আপনাদের কেউ কেউ পথে নেমেছিলেন। ঠিক তেমনি ভবিষ্যতে দেশটা যেন ধর্মের নামে মানুষের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা, দেশপ্রেমের নামে দেশের মানুষকে নিঃস্ব করে দেওয়া ভূতদের খপ্পরে যাতে না পড়ে যায় সেকথা ভাবুন। এই সিদ্ধান্ত এখনই না নিলে ভবিষ্যতে ভারত নামে দেশটিই থাকবে না। ইতিহাস, ভূগোল, ধর্ম, ভালোবাসার অর্থ বদলে দেওয়া বিজেপি নামক দলটি গোটা দেশটাকেই গোল্লায় পাঠাবে।

একটু জ্ঞানবুদ্ধি হওয়ার পর থেকেই শুনে আসছি সাংস্কৃতিক জগতের মানুষ ও বুদ্ধিজীবীরা সমাজের অগ্রণী অংশ। কিন্তু তাদের একটা বড় অংশ প্রতিনিয়ত বলে চলেন – আমরা সিনেমা করি, লেখালিখি করি, ছবি আঁকি, নাটক করি কিন্তু রাজনীতিটা ঠিক আমাদের বিষয় নয়। সেই বলার ভঙ্গীতে রাজনীতি করা লোকজনদের প্রতি একটা নীরব তাচ্ছিল্য থাকে। আপনাদের অনেকে সেই ঐতিহ্যকে সগর্বে বহন করে নিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু আমার অবাক লাগে যখন দেখি কোন প্রতিষ্ঠানের লোভনীয় পদ পেতে বা কোন গুরুত্বপূর্ণ কমিটির সদস্য হওয়া বা কোন পুরষ্কার বা স্বীকৃতি বাগানোর জন্য অন্যায়ভাবে রাজনীতি করতে বা রাজনীতির মানুষদের দ্বারস্থ হতে আপনাদের অনেকেরই বাঁধেনা। সব আমলেই এর অসংখ্য উদাহরণ রয়েছে। কাজ মিটে যাওয়ার পর আবার স্বমূর্তি ধরেন আপনারা! বলতে শুরু করেন আমি ঠিক রাজনীতির লোক নই আমাকে এর সঙ্গে জড়াবেন না!
বাংলার তৃণমূল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আপনাদের খুবই গুরুত্ব দেন, সেটাই স্বাভাবিক। বহু অনুষ্ঠানে মন্ত্রী এবং প্রশাসনের শীর্ষকর্তাদের পিছনের সারিতে পাঠিয়ে দিয়ে আপনাদের ডেকে নিয়ে সামনের সারিতে বসান। আমাদের দিদির আমলে আপনাদের প্রাপ্তিযোগও কম নয়। যোগ্যতার স্বীকৃতি হিসেবে নানা ধরণের সন্মান ও পুরষ্কার পেয়েছেন আপনারা। আসীন হয়েছেন রাজ্যের বহু সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের উচ্চপদে। আপনাদের অনেকের রাজনৈতিক বিশ্বাস এসব পাওয়ার পক্ষে অন্তরায় হয়নি। তবুও আপনারা এখনও সরকারের নানা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সরব হন। গণতন্ত্রে সেই অধিকার নিশ্চয়ই রয়েছে। যেমন সম্প্রতি শহরের কোন কোন জায়গায় ভূতের ভবিষ্যৎ ছবির প্রদর্শন বন্ধ করে দেওয়ার বিরুদ্ধে সরব হয়েছিলেন আপনারা।
ঠিক তেমনভাবেই আগামী ভোটে নিজেদের অবস্থান প্রকাশ করুন আপনারা। কৃষক, শ্রমিক থেকে শুরু করে দেশের কোটি কোটি মানুষের ওপর চরম দুর্দশা নামিয়ে আনা বিজেপি সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন আপনারা। আপনারাই বলেন, কেন্দ্রীয় সরকার অন্যায়ভাবে হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতি চাপিয়ে দিচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষ দেশের মানুষের ওপর। ভোটই তো এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সময়। কারণ, এদের ইতিহাস বলছে এরা ক্ষমতায় এলে আপনাদের বিপদ সবথেকে বেশি। কারণ, আপনাদের সব স্বাধীন সৃষ্টিকর্ম এরা ক্ষমতায় ফিরলে বস্তুত বন্ধ হয়ে যাবে।
আমার মত এক সামান্য মানুষের অনুরোধ, আপনাদের সৃষ্টিকর্ম হয়ে উঠুক বিজেপিকে দেশের ক্ষমতা থেকে সরানোর হাতিয়ার। ২০১৯এর নির্বাচন আপনাদের দরজায় এই প্রত্যাশা নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে। মোদি-অমিত ব্রিগেডের বিরুদ্ধে কণ্ঠ, কলম, অভিনয়, নাটক, ক্যামেরা, মঞ্চ, তুলি, ভাবনা দিয়ে লড়াইয়ে সামিল হন আপনারা। নিজেদের অভিজ্ঞতা দিয়েই আপনারা দেখেছেন বিজেপির জমানায় আপনাদের কাজের পরিসরটাই নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। নিয়ন্ত্রণ চাপানো হচ্ছে স্বাধীন সৃষ্টিকর্মের ওপর। এর প্রতিবাদ আপনাদেরই করতে হবে। সোশ্যাল মিডিয়ায় সকাল থেকেই নানা বিষয়ে আপনাদের কবিতা, গান, মন্তব্য ভেসে উঠতে দেখে ভালোই লাগে। এবার এসবকিছুর পাশাপাশি মোদি-অমিতদের নানারকম অপকর্মের বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ ও বিশ্লেষণ দেখতে চাই। কবিতা ও গানের মধ্যে দিয়েও প্রতিবাদ জানানো যেতে পারে।
আপনাদের মধ্যে যারা এখনও রাজনীতি করাটাকে শুধু আমজনতার বিষয় বলে মনে করে থাকেন তাদের বলি, উটপাখির মত ঝড়ের সময় বালিতে মুখ বুজে বসে থাকবেন না। কারণ, অন্ধ হলেও প্রলয় বন্ধ থাকে না। নিষ্ক্রিয়তা আপনাদের নিজেদের অস্তিত্বই বিপন্ন করবে। যদি মনে করেন দিদি মানুষের জন্য কাজ করেছেন, রাজ্যের পরিকাঠামো, নাগরিক স্বাচ্ছন্দ্য, গরিব মানুষের বিকাশ সবকিছু এগিয়েছে, যদি মনে করেন তৃণমূল আমলে রাজ্যের অর্থনীতি, সংস্কৃতি, রাজনীতি সবকিছুতেই ইতিবাচক পরিবর্তন এনেছেন তাহলে আপনাদের আগামী লোকসভা নির্বাচনে জোর গলায় তৃণমূল কংগ্রেস প্রার্থীদের ভোট দেওয়ার কথা এবং বিজেপিকে পরাস্ত করার কথা বলতেই হবে। কারণ, দেশের মানুষের ভবিষ্যৎ কোনদিনই ভূতের ভবিষ্যৎ হয়না।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত