নোটবন্দী নিয়ে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিচালন বোর্ড। কিন্তু শেষপর্যন্ত একপ্রকার বাধ্য হয়েই মোদী সরকারের প্রস্তাবে সীলমোহর দিতে হয়েছিল তাদের। তবে এরপরও বোর্ডের বৈঠকের কার্যবিবরণী পড়ে এ প্রশ্ন জাগে যে, ডিরেক্টরদের আপত্তিগুলি বা সরকারি যুক্তির খন্ডন যেখানে এত স্পষ্টভাবে উচ্চারিত হয়েছিল, সেখানে কী করে এত দ্রুত একটা সিদ্ধান্ত হয়ে গেল?
প্রসঙ্গত, ২০১৬-র ৮ নভেম্বর রাত আটটায় নোটবন্দীর কথা ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। কিন্তু তার মাত্র আড়াই ঘণ্টা আগেই বৈঠকে বসেছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্কের বোর্ড। বৈঠকের আলোচ্যসূচী পেশ, আগের বোর্ড বৈঠকের কার্যবিবরণীতে স্বাক্ষরদান এবং একজন ডিরেক্টর নটরাজন চন্দ্রশেখরনের অনুপস্থিতি মঞ্জুর হওয়ার পরই ওঠে মূল প্রসঙ্গ, ‘নোট বাতিল সংক্রান্ত প্রস্তাব’।
ডেপুটি গভর্নর আর গান্ধী পেশ করেন মেমোরেন্ডামটি। সঙ্গে অর্থ মন্ত্রকের চিঠি, যেটি এসেছিল ঠিক তার আগের দিনই অর্থাৎ ৭ নভেম্বর। কার্যবিবরণীর ৪ নং বিষয় নোটবন্দী। এর প্রথম দুটি অনুচ্ছেদে রয়েছে মূল প্রস্তাব এবং সরকারের যুক্তি। তারপর ৪.৩ অনুচ্ছেদে ডিরেক্টরদের বক্তব্য নথিভুক্ত হয়েছে। তাতে মোট ৬টি কথা রয়েছে।
সংক্ষেপে সেগুলো এরকম: ১) এই পদক্ষেপ ‘প্রশংসনীয়’ হলেও স্বল্পমেয়াদী খারাপ প্রভাব পড়বে আর্থিক বৃদ্ধিতে, ২) ওষুধের দোকানে ছাড় দেওয়ার যে কথা রয়েছে, তা বেসরকারি ওষুধের দোকানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত, ৩) দূরপাল্লার যাত্রীরা স্টেশন বা বিমানবন্দরে নেমে হঠাৎ ধাক্কা খাবেন বড় নোট নিয়ে, ৪) আর্থিক বৃদ্ধির তুলনায় বাজারে ছাড়া ৫০০ ও ১০০০ টাকার নোটের পরিমাণ বেড়েছে অনেক বেশি হারে, এই সরকারি তথ্যে যতটা ফারাক দেখান হয়েছে, মূদ্রাস্ফীতির বিষয়টি বিবেচনা করলে বোঝা যাবে আসলে ফারাক ততোটা নয়, ৫) জাল নোটের প্রতিটি ঘটনাই উদ্বেগের, তবে বাজারের মোট নগদ টাকার অনুপাতে ৪০০ কোটি টাকার জাল নোট খুব গুরুতর কিছু নয়, ৬) নগদে নয়, কালো টাকার বড় অংশই আসলে রয়েছে সোনাদানা, বাড়ি ইত্যাদি রিয়েল-সেক্টর অ্যাসেটে।
কার্যবিবরণীর পরের তিনটি অনুচ্ছেদে দেখা যাচ্ছে, এতটা ভিন্নমত সত্ত্বেও বোর্ড সদস্যরা সরকারি প্রস্তাব মেনে নিচ্ছেন। কেননা, তাঁদের ‘আশ্বস্ত’ করা হয়েছে, এইসব বিষয় নিয়ে আগের ৬ মাস ধরে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের সঙ্গে সরকার কথাবার্তা বলেছে। সব মিলিয়ে ‘বৃহত্তর জনস্বার্থে’ ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের প্রস্তাব গ্রহণ করেছে বোর্ড, লেখা হয়েছে বিবরণীতে। এবং ওই পদক্ষেপকে ‘প্রশংসনীয়’ বলে মন্তব্য করা হয়েছে। এই ‘বৃহত্তর জনস্বার্থ’ কথাটায় যে যথেচ্ছ ধোঁয়াশা রয়েছে তা বলাই বাহুল্য।
তবে এতকিছুর পরেও বোর্ডের বৈঠকে কালো টাকা আর জাল টাকা সংক্রান্ত বিষয় দুটি নিয়ে ডিরেক্টররা ভিন্ন মতই জানিয়েছেন। কারণ নোটবন্দী কালো টাকাকে খতম করবে – মোদী সরকারের এমন যুক্তি রিজার্ভ ব্যাঙ্কের তৎকালীন পরিচালন বোর্ড সদস্যদের সকলকে সন্তুষ্ট করতে পারেনি। কিন্তু তাঁদের ভিন্ন মতকে কীভাবে খন্ডন করা হল সেটা কার্যবিবরণীতে নেই।
আর সবচেয়ে বড় খবর, বোর্ডের লিখিত অনুমোদন এসে পৌঁছনোর আগেই মধ্যরাত থেকে পুরনো ৫০০ এবং ১০০০ টাকার নোট বাতিলের কথা ঘোষণা করে দেন মোদী। তার এক সপ্তাহ পর ১৬ নভেম্বর নোট বাতিল নিয়ে নিজের মতামত সরকারকে জানিয়েছিল রিজার্ভ ব্যাঙ্ক। এর থেকেই এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে রিজার্ভ ব্যাঙ্কের পরিচালন বোর্ডের মতামতের কোনও গুরুত্বই ছিল না মোদী সরকারের কাছে। তাই বোর্ড সদস্যরা সায় দেওয়ার আগেই নোটবন্দীর ঘোষণা করে দিয়েছিল তারা।