নানুরের উচকরণ গ্রামের ছোট্ট বাড়িটিতে কোনও জৌলুস নেই। বৃদ্ধ বাবা-মা। বাড়ির আনাচ কানাচে দারিদ্রের ছাপ সুস্পষ্ট। তবু এই বাড়িতেই এসেছিল জাতীয় সাফল্যের আলো। তবু তাকে ধরে রাখতে পারলেন কই? লাভপুরের লোকনাথ হাজরার বোলপুর স্পোর্টস অথরিটি অফ ইন্ডিয়াতে তিরন্দাজির প্রশিক্ষণ শুরু হয় স্কুল পাশ করার পরই। আন্তঃজেলা ও রাজ্যস্তরে নাম ছড়াতে শুরু করে। ২০১৪ সালে রাজ্য তিরন্দাজি অ্যাসোসিয়েশনের পরিচালনায় সল্টলেকের সাই সেন্টারে অনুষ্ঠিত হয় সারা বাংলা তৃতীয় আন্তঃজেলা এবং রাজ্যস্তরের তিরন্দাজি প্রতিযোগিতা। রাজ্যের ২৫০ জন প্রতিযোগী যোগ দিয়েছিলেন তাতে। বীরভূমের মোট ২৫ জনের মধ্যে অনূর্ধ্ব ১৯ বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে নেন নানুরের লোকনাথ। একে একে কলকাতা, অসম, হরিয়ানার নানা জায়গা থেকে পাওয়া পদক ও সার্টিফিকেটে ভরে ওঠে ঘর। সোনা, রূপো, ব্রোঞ্জ মিলে কমপক্ষে ন’টি পদক ও প্রশংসাপত্র রয়েছে লোকনাথের ঝুলিতে। তবুও দারিদ্র্যতার কাছে হার মানে স্বপ্ন। লাভপুর থেকে কয়েক কিলোমিটার দূরত্বে নিজের ছোট্ট একটেরে ঘরে থাকেন আর এক সোনাজয়ী তিরন্দাজ লোকনাথ হাজরা। পেটের ভাত জোটাতে তির-ধনুক ছেড়ে যিনি এখন টোটো চালক।
নানুরের উচকরণ গ্রামের ছোট্ট বাড়িটিতে কোনও জৌলুস নেই। বাড়ির আনাচ কানাচে দারিদ্রের ছাপ সুস্পষ্ট। রঙচটা দেওয়ালের শোভা বাড়িয়েছে নানা সময় পাওয়া সোনা, রূপো, ব্রোঞ্জের মেডেল আর সার্টিফিকেট। যত্ন করে সে গুলোই বুকে জড়িয়ে রেখেছেন তেইশের যুবক। টোটোতে চাপিয়ে মানুষজনকে পারাপার করাই এখন তাঁর কাজ। স্বপ্ন সন্ধানী মনে আর বিশেষ কোনও উচ্চাশা নেই। তিরন্দাজির স্বপ্নে ইতি পড়েছে ২০১৬ সালে। এখন টোটোর স্টিয়ারিংয়েই বাঁধা জীবন। তাতেই যে দু’পয়সা আয় হয় তিনটে পেট কোনও রকমে চলে যায়। সোনার মেডেল দেওয়ালে সাজিয়ে, লোকনাথ হারানোর দিনের স্বপ্ন দেখেন।
‘‘বাবা চাষের কাজ করতেন। আমাকে সবসময় উৎসাহ দিয়েছেন। অভাবের সংসারেরও তিরন্দাজিকে লক্ষ্য করে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। স্বপ্ন বুনছিলাম দেশের মুখ উজ্জ্বল করার। রাজ্যস্তরে সাফল্যের পর তাই প্রশিক্ষণ নিতে পঞ্জাবে পাড়ি দিই,’’ স্মৃতির পথে হাঁটলেন লোকনাথ। জানালেন, ভালোই চলছিল প্রশিক্ষণ। কিন্তু, বাবা অসুস্থ হয়ে পড়ায় পঞ্জাব থেকে ফের গ্রামে ফিরে আসতে হয় তাঁকে। সালটা ২০১৬। সেই শেষ। গ্রাম থেকে আর ফিরে যাওয়া হয়নি পঞ্জাবের প্রশিক্ষণ শিবিরে। ‘‘সংসারের হাল ধরার দরকার ছিল। বাবার পর আমিই ছিলাম একমাত্র রোজগেরে। টাকা রোজগার করতে তাই তিরন্দাজিকে বিদায় জানাতে হয়,’’ লোকনাথের চোখে একরাশ শূন্যতা। কখনও কি আবার তির-ধনুক হাতে তুলে নিতে পারবেন? উত্তরটা অজানা। তবু স্বপ্ন দেখা ছাড়েননি লোকনাথ।