শেক্সপিয়ার বলেছিলেন ‘নামে কী আসে যায়’! কিন্তু বাঙালির কাছে চিরকালই নাম এবং নামকরণ হল একটি আবেগের জায়গা। ফলে সবসময়ই তাতে বুদ্ধিমত্তার ছাপই খুঁজতে চায় তারা। যে নাম যত সহজ-সরল এবং শ্রুতিমধুর, সেই নামই ততো বেশি করে গেঁথে যায় বাঙালির মননে। ‘কন্যাশ্রী’, ‘সবুজসাথী’, ‘নিজশ্রী’, ‘খাদ্যসাথী’…সোজাসাপ্টা এই নামগুলো বেশ পরিচিত। রাজ্যের বিপুল সংখ্যক মানুষ এই সব প্রকল্পের সুবিধা পাচ্ছেন। তাই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের উন্নয়নমুখী ও জনকল্যাণমুখী চিন্তাভাবনার পাশাপাশি গত কয়েক বছরে রাজ্য সরকারের প্রকল্পগুলির সফল ব্র্যান্ডিংয়ের পিছনে মমতার করা নামকরণকেও অন্যতম প্রধান কারণ বলে মনে করছেন বিপণন বিশেষজ্ঞরা।
কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, উৎকর্ষ বাংলা প্রকল্প ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভ করেছে। জাতীয় স্তরের স্বীকৃতি আদায় করেছে খাদ্যসাথী-সহ আরও বেশ কিছু প্রকল্পও। বিজ্ঞাপন বিশেষজ্ঞ অমিতাভ সিনহার মতে, ‘কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, খাদ্যসাথীর মতো প্রকল্পগুলি নির্দিষ্ট লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সক্ষম হয়েছে। সে কারণেই প্রকল্পগুলির সঙ্গে একাত্মবোধ করছেন সাধারণ মানুষ।’ কিন্তু এই প্রকল্পগুলির সাফল্যের পিছনে প্রচারের ভূমিকা কতখানি? তাঁর মতে, ‘যে কোনও প্রকল্পের সাফল্যের পিছনে মার্কেটিং এবং ব্র্যান্ডিং-এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকে। কিন্তু কোনও প্রকল্প যদি নির্দিষ্ট প্রয়োজন মেটাতে সক্ষম না হয়, তবে তার সফল হওয়া কঠিন।’
নিছক প্রচার নয়, প্রকল্পগুলির সফল রূপায়ণের বিষয়ে বরাবরই সচেষ্ট মুখ্যমন্ত্রী। বর্তমানে খাদ্যসাথী প্রকল্পে ২ টাকা কিলোয় চাল পাচ্ছেন সাড়ে ৭ কোটি মানুষ। কন্যাশ্রী প্রকল্পের আওতায় এসেছেন ৬০ লাখের বেশি ছাত্রী। সবুজসাথী প্রকল্পে ইতিমধ্যেই ১ কোটি ছাত্রছাত্রী নতুন সাইকেল পেয়েছে। অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকারের মতে, ‘এখন গ্রামাঞ্চলে নতুন পাকা রাস্তায় সাইকেলে চেপে ছাত্রছাত্রীরা যখন স্কুলে যাচ্ছে, তখন তাদের স্কুলে যাওয়ার আগ্রহ বাড়ছে। একই সঙ্গে, ছাত্রীদের কন্যাশ্রীর সুযোগ মেলায় প্রকল্পগুলির সম্মিলিত ফল হিসেবে একটি নেটওয়ার্ক এফেক্ট তৈরি করছে।’
কন্যাশ্রী, সবুজসাথী, খাদ্যসাথী, যুবশ্রী, শিক্ষাশ্রী, জল ধরো-জল ভরো, কৃষকবন্ধু, উৎকর্ষ বাংলা, সমব্যাথীর মতো প্রকল্পগুলির রূপরেখা তৈরি করেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় নিজেই। নামকরণও তাঁরই। এমনকী, কন্যাশ্রী, উৎকর্ষ বাংলা, বিশ্ব বাংলার লোগোও তিনি নিজের হাতেই তৈরি করেছেন। সুন্দরবন-সহ রাজ্যের দুর্গম কিছু প্রান্তে স্কুলের ছাত্রছাত্রীদের সাইকেল বিলি, জঙ্গলমহলের কিছু অংশে সস্তায় চাল বিলি কিংবা দুঃস্থ ছাত্রছাত্রীদের স্কলারশিপের মতো কিছু প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল বাম জমানাতেও। কিন্তু সেগুলি নেহাতই প্রতীকী হিসেবে থেকে গিয়েছিল। ব্যাপকতা এবং ব্র্যান্ডিং – কোনও নিরিখেই তা বর্তমান সরকারের ধারকাছেও পৌঁছতে পারেনি।
আবার, তৃণমূল জমানার প্রতিটি প্রকল্পেরই এমন আকর্ষণীয় কিন্তু সোজাসাপ্টা নামকরণ করা হয়েছে, যা সহজেই মানুষের মনে দাগ কাটছে। যেমন মৃতদেহ সৎকারের জন্য রাজ্যের প্রকল্পটির নাম ‘সমব্যথী’। আবার রাজ্যের স্বাস্থ্য বিমার প্রকল্পটির নাম ‘স্বাস্থ্যসাথী’। ব্র্যান্ডিং বিশেষজ্ঞ কৌশিক ভট্টাচার্যর মতে, ‘প্রকল্পগুলির নামগুলি অত্যন্ত সোজা-সরল। প্রকল্পগুলির নামগুলিতেই তার উদ্দেশ্য স্পষ্ট, যা সহজেই মানুষের মন ছুঁয়ে যায়। যেমন, খাদ্যসাথী, জল ধরো-জল ভরোর মতো প্রকল্পগুলির নামই যথেষ্ট। বিশদে কিছু বলার দরকার পড়ে না।’
তাঁর মতে, ‘প্রকল্পগুলির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলার পর সে কথাও প্রচারে আনছে রাজ্য। ফলে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রকল্পগুলির বিশ্বাসযোগ্যতা বাড়ছে। সব মিলিয়ে প্রকল্পগুলির ৩৬০ ডিগ্রি কভারেজে প্রচার করছে রাজ্য।’ আবার অর্থনীতিবিদ অজিতাভ রায় চৌধুরী বলেন, ‘ছাত্রীদের সহায়তা, সাইকেল বিলির মতো বেশ কিছু প্রকল্প রয়েছে অন্যান্য রাজ্যেও। কিন্তু, মিড-ডে মিল প্রকল্পের সফল রূপায়ণের পর কন্যাশ্রী, সবুজসাথীর মতো প্রকল্পগুলির সফল রূপায়ণ হিউম্যান ক্যাপিটাল তৈরির ক্ষেত্রে সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। নিছক প্রচার নয়, প্রকল্পগুলির কার্যকারিতা এবং সফল বাস্তবায়নই তার সাফল্যের অন্যতম কারণ।’
বাংলার জননেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আমলে মা-মাটি-মানুষের সরকারের প্রতিটি প্রকল্পই যে যথেষ্ট সাফল্য অর্জন করেছে তা মেনে নিচ্ছেন বিরোধীরাও। রাজ্য বিধানসভায় বামেদের পরিষদীয় দলনেতা সুজন চক্রবর্তী বলেন, ‘সাইকেল বিলি কিংবা ছাত্রছাত্রীদের আর্থিক সহায়তা প্রকল্প যে এ রাজ্যে আগে ছিল না এমন নয়। তবে নিশ্চিত ভাবেই এই জমানায় প্রকল্পগুলিকে উন্মুক্ত করে দেওয়ায় তার বিস্তৃতি অনেকটাই বেড়েছে। সঙ্গে পেশাগত দক্ষতায় নিরন্তর প্রচার প্রকল্পগুলির ব্র্যান্ডিং-এ সাহায্য করেছে।’