পুলওয়ামায় জঙ্গী হামলার পর থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছে গোটা দেশ। সোশ্যাল মিডিয়া জুড়ে উঠছে দেশপ্রেমের জিগির৷ আর এই দেশপ্রেমকে পুঁজি করেই ভোটের আগে নানা রাজনৈতিক কর্মসূচি নিচ্ছে বিজেপি৷ এবার যেমন দেশপ্রেমের আবেগকে জিইয়ে রাখতে আন্তর্জাতিক নারী দিবসে দুই শহীদ পরিবারের সদস্যদের রাজ্য বিজেপি পার্টি অফিসে হাজির করা হয়েছিল। শোনা গিয়েছিল, পার্টি অফিস থেকে শ্যামবাজার পর্যন্ত তাঁদের নাকি মিছিলে হাঁটানো হবে।
যদিও শহিদ পরিবারের সদস্যদের দাবি, গেরুয়া শিবিরের তরফে বলা হয়েছিল, শুক্রবার কেন্দ্রীয়মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি মহাজাতি সদনে তাঁদের সংবর্ধনা দেবেন। কিন্তু গতকাল দুপুরে পার্টি অফিসে গিয়ে শহীদ পরিবারের সদস্যরা আবিষ্কার করেন, গোটাটাই আষাঢ়ে গল্প। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী তো দূরঅস্ত, মহাজাতি সদনে অনুষ্ঠানের কোনও পরিকল্পনাই নেই। তারপরই কার্যত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন পুলওয়ামাকাণ্ডে নিহত জওয়ান বাবলু সাঁতরার মা ও দিদি। একই অভিজ্ঞতা আরেক শহীদ জওয়ান বিনয় প্রসাদের পরিবারও।
বন্যার বয়স দেড় বছর। তার মায়ের মুখ সাদাটে, ফ্যাকাশে। সেই মুখ, শুধু ঝড়ঝাপটায় তছনছ হয়ে যাওয়া জীবনের কথাই বলে। শুক্রবার ৬ নম্বর মুরলীধর সেন লেনে বিদ্যা যখন তাঁর ফুটফুটে মেয়েকে নিয়ে বসে, তখনও তাঁর মুখে-চোখে অদ্ভুত নিস্পৃহতা। একই রকম থমথমে বনমালা সাঁতরা, ভগবতী বিশ্বাস ও সুশীল পাল। বিজেপি রাজ্য দফতরে তখন শোরগোল। নারী দিবসের মিছিল বেরোবে। লকেট, শশী, কেয়ার মতো নেত্রীরা সবাই মিছিল সফল করতে ব্যগ্র। মৌসুমিকে বলা হয়েছে, ‘ওঁদের বসিয়ে রাখুন!’
বিদ্যা বিজেপি দফতরে এসেছিলেন তাঁর দেওর বিকাশপ্রসাদ, শাশুড়ি শকুন্তলা দেবীর সঙ্গে। বিদ্যার স্বামী বিএসএফ কমান্ডান্ট বিনয়প্রসাদ এই জানুয়ারিতে জম্মুতে টহলদারির সময় জঙ্গী হানায় মারা গেছেন। বিদ্যা এখনও শোক কাটিয়ে ওঠার সময় পাননি। মা শকুন্তলা দেবীও যেন শোকে পাথর। আর সাঁতরা পরিবারের কাছে বাবলুর মৃত্যু আরও টাটকা। পুলওয়ামায় জঙ্গী হানায় সিআরপিএফ জওয়ান বাবলু সাঁতরার প্রাণ গেছে। তাঁর স্ত্রী বিজেপির রাজ্য দফতরে না এলেও, এসেছিলেন বাবলুর বন্ধু ও প্রতিবেশী সুশীল পাল, দিদি ভগবতী বিশ্বাস, মা বনমালা সাঁতরা।
বিকাশপ্রসাদ ও সুশীল পাল দুজনেই জানান, সম্মান দেওয়ার জন্য তাঁদের ডাকা হয়। বলা হয়েছিল, দিল্লী থেকে স্মৃতি ইরানি এসে মহাজাতি সদনে এক অনুষ্ঠানে তাঁদের সম্মান জানাবেন। বাস্তবে, এদিন বাংলায় স্মৃতি ইরানির কোনও কর্মসূচি ছিল না। শহীদ পরিবার দুটিকে মিছিলের কথা বা নারী দিবসের কথা বলা হয়নি। দুই শহীদ পরিবারের বাড়িই হাওড়ায়। জানা গেছে, হাওড়া বিজেপির উমেশ রাই ও তাঁর স্ত্রী অনিতা রাই-ই দুই শহীদ পরিবারের সঙ্গে কথা বলেন। তাঁদের ভুল তথ্য জানান। আর শুক্রবার তাঁদের হাওড়া থেকে নিয়ে আসেন সুরিন্দর জৈন।
তবে দুই শহীদ পরিবারের সদস্যদের কেউই মিছিলে যেতে রাজি হননি। দু’টি পরিবারই একসুরে জানায়, তাঁরা কোনও রাজনৈতিক দলের সদস্য নন, স্বভাবতই বিজেপির মহিলা মোর্চার মিছিলে হাঁটার প্রশ্ন নেই। পরিস্থিতি জটিল হওয়ার আশঙ্কায় মিছিল শুরুর পরই দলের কেন্দ্রীয় সম্পাদক রাহুল সিনহা তড়িঘড়ি তাঁদের সম্মাননা জানান। ফলে প্রশ্ন উঠছে, একেই কি বলে রাজনীতি? বিভ্রান্তিকর তথ্য পরিবেশন করে কেন বিজেপি পার্টি অফিসে শহিদ পরিবারের সদস্যদের টেনে আনা হল? দলের অন্দরেও এ নিয়ে তৈরি হয়েছে তীব্র ক্ষোভ। দলের রাজ্য কমিটির এক নেতার দাবি, এই ঘটনা চূড়ান্ত অপেশাদার মানসিকতার নিদর্শন। সমন্বয়ের অভাবের জন্যই দলের মুখ পুড়ল বলে মনে করেন তিনি।