বারবারই নিজেকে দেশের ‘চৌকিদার’ বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর দাবি, দেশে ‘আচ্ছে দিন’ এনেছেন তিনি। কিন্তু সেই আচ্ছে দিন এমনই যে এবার দেশের শীর্ষ কোর্টে দাঁড়িয়ে খোদ চৌকিদারের সরকারই জানাল, ‘চুরি’ গিয়েছে গুরুত্বপূর্ণ রাফাল চুক্তির নথিপত্র!
প্রসঙ্গত, ফ্রান্সের সংস্থার সঙ্গে হওয়া রাফাল চুক্তির নথি থাকার কথা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকে। যার দফতর সাউথ ব্লকে। ওই একই ভবনে রয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দফতর এবং বিদেশ মন্ত্রকের অফিস। এমন সুরক্ষিত জায়গা থেকে রাফাল নথি চুরি মানে তো খোদ চৌকিদারের নাকের ডগা থেকে চুরি! যা শুনে বিস্মিত বিচারপতিরাও। অন্যদিকে, রাফাল চুক্তিতে নতুন করে তদন্তের দাবি ঠেকাতে গিয়ে দেশের শীর্ষ আদালতে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের তরফে এমন দাবি কার্যত নতুন অস্ত্র তুলে দিয়েছে বিরোধীদের হাতে।
রাফাল চুক্তিতে দুর্নীতির অভিযোগ তুলে সরাসরি প্রধানমন্ত্রীকে নিশানা করে গত বছর থেকেই সরব কংগ্রেস সভাপতি রাহুল গান্ধী ও বাংলার মুখ্যমন্ত্রী তথা তৃণমূল সুপ্রিমো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। রাহুল বারবারই এই স্লোগান তুলেছেন যে, ‘চৌকিদারই চোর হ্যায়’! আর গতকাল রাহুল অভিযোগ করেন, দুর্নীতি ধামাচাপা দিতে, প্রমাণ লোপাট করতেই সরকার এই দাবি করছে।
কংগ্রেস মুখপাত্র রণদীপ সিংহ সুরজেওয়ালার কথায়, “চৌকিদার তো চুরি করেছেন। এখন চৌকিদারের নাকের ডগা থেকেও চুরি হচ্ছে! এটি পুরোটাই ‘কভার আপ’ অপারেশন। যে ভাবে যাবতীয় আপত্তি উপেক্ষা করে প্রধানমন্ত্রী রাফাল নিয়ে অনিয়ম করেছেন, তা এখন স্পষ্ট। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতির প্রাথমিক অভিযোগ দেখা যাচ্ছে। ফলে তাঁর বিরুদ্ধে এফআইআর দায়ের করে অবিলম্বে তদন্ত শুরু হওয়া দরকার।’’
রাফাল চুক্তি নিয়ে বিতর্কের আবহে চুক্তির ফাইলের বেশ কিছু অংশ সংবাদমাধ্যমে সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। তাতে দেখা গিয়েছে, রাহুল গান্ধী যেমন রাফাল চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন, তেমনই প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের অন্দরমহল থেকেও আপত্তি উঠেছিল। রাফাল চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রীর দফতরের নাক গলানো নিয়েও আপত্তি ওঠে। যে আপত্তির কথা জানতেন তৎকালীন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মনোহর পরীক্করও। কিন্তু সব আপত্তি নাকচ করে দেওয়া হয়। এই ফাইলকে অস্ত্র করেই সুপ্রিম কোর্টে দাবি ওঠে, রাফাল চুক্তিতে তদন্তের দাবিতে মামলায় আদালতের রায়ের পুনর্বিবেচনা হোক। কারণ এর আগে কোর্ট সেই দাবি নাকচ করে দেয়।
রাফাল নিয়ে নতুন করে তদন্তের আর্জি ঠেকাতে আজ সুপ্রিম কোর্টে কেন্দ্রের অ্যাটর্নি জেনারেল কে কে বেণুগোপাল দাবি করেন, রাফাল চুক্তি সংক্রান্ত ফাইল চুরি হয়েছে। এর পরেই রাহুল বলেন, ‘এ বার প্রধানমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় তোলার যথেষ্ট প্রমাণ রয়েছে। দুর্নীতি তাঁকে দিয়েই শুরু হচ্ছে, তাঁকে দিয়েই শেষ হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীকে দোষারোপ করা গুরুত্বপূর্ণ রাফাল ফাইল এখন চুরি হয়ে গিয়েছে বলে সরকার দাবি করছে। এটা আসলে প্রমাণ লোপাট ও কভার-আপ।’ রাহুলের দাবিকে সমর্থন জানান তৃণমূলের ডেরেক ও’ব্রায়েনও।
অন্যদিকে, সাউথ ব্লকের মতো সুরক্ষিত জায়গা থেকে রাফাল ফাইল চুরি গিয়েছে শুনে বিচারপতিরাই চমকে যান। এক মাস আগে ওই ফাইলের তথ্য সংবাদমাধ্যমে প্রকাশ হয়েছে। প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ প্রশ্ন তোলেন, ‘কবে, এক মাস আগে? কী করেছেন?’ বেণুগোপাল জানান, তদন্তের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। প্রধান বিচারপতি জানতে চান, তার পরে কী হয়েছে! বিচারপতি সঞ্জয় কিষেণ কউল মন্তব্য করেন, নথি চুরি হয়ে গেলে সরকারের নিজের ঘর সামলানো উচিত।
কেন্দ্রের দাবি, চুরি যাওয়া ‘গোপন ফাইল’ প্রকাশ করে সরকারি গোপনীয়তা আইন বা ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’ লঙ্ঘন করেছে ‘দ্য হিন্দু’ সংবাদপত্র। কেন্দ্রের আইনজীবীর এই মন্তব্যকে কার্যত হুঁশিয়ারি হিসেবেই দেখছেন বিরোধীরা। ক্ষুব্ধ বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতাও। টুইটারে তিনি বলেন, “গণতন্ত্রে সংবাদমাধ্যমের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। দেশের প্রবীণ এবং শ্রদ্ধেয় সম্পাদকদের অন্যতম এন রামকে ভয় দেখানোর জন্য বিজেপি সরকারের তীব্র নিন্দা করছি। সাংবাদিকদের ভয় দেখাতে ‘অফিসিয়াল সিক্রেটস অ্যাক্ট’-এর ব্যবহার লজ্জাজনক।”
শুধু কংগ্রেস বা তৃণমূলই নয়, দেশের প্রায় সবকটি বিরোধী দলের দাবি, সরকার স্পষ্ট বোঝাতে চাইছে যে সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনও তথ্য ফাঁস হলেই আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। সরকারের আরও যুক্তি, প্রতিবারই শুনানির আগে একটি খবর প্রকাশ করে আদালতকে প্রভাবিত করার চেষ্টা হচ্ছে। এটা আদালত অবমাননার সামিল।