সেই ট্রাডিশন সমানে চলিতেছে। ছোটবেলায় কোন বক্তব্য পোক্ত করতে হলে সেটা মা বলেছে, বাবা বলেছে বা একটু এক্সট্রা প্রোটেকশনের দরকার পরলে স্বামী বিবেকানন্দ বা আইনস্টাইনের নামে চালিয়ে দিতাম। এরা কেউ হয়তো কোনদিন ওসব বলেনি। কিন্তু ওই নামগুলোর দরকার পরতো বিরোধীদের চুপ করিয়ে দিতে৷ মা বা বাবা মিথ্যে বলতে পারেনা৷ এটা অলিখিত নিয়ম। আর কোন পাকা বাচ্চা যদি এরপর ও সন্দেহ প্রকাশ করতো, বলতে হতো, “ও, তার মানে তুই বলতে চাস আমার মা বাবা মিথ্যুক?”। বলেই সবাইকে একজোট করে কেলিয়ে দিতে হবে নয়তো ফাঁস হয়ে যেতে পারে অনেককিছু।
সেরকমই ছোটবেলায় কোন কথাকে সত্য হিসেবে ধরে নেওয়া ও প্রমাণ করানোর ব্রহ্মাস্ত্র ছিল, ” মা কালীর দিব্বি”। এই মা কালীকে মাঝখানে আনলে আর কোন কথা থাকতেই পারেনা। তার মানে সে সত্যি কথা বলছে। কারণ মা কালী সব শোনে, দেখে,বিচার করে।
ভেবেছিলাম ছোটবেলার এই নুরিপাথরগুলো ফেলে এসেছি। কিন্তু বড়বেলাতেও এরকম সব জিনিস ঘটে চলেছে। আমি কিন্তু দেশ পাল্টাই নি।
ধরুন দাদা ঢপ মেরে চলেছে। তাকে পাল্টা প্রশ্ন করলেই সে কিম্ভুত একটা যুক্তি দিচ্ছে। এবার সেটা বিশ্বাস না করলেই বলছে, তার মানে অমুক বাহিনী মিথ্যুক বলতে চাইছো? তারপর মার।
এক্সট্রা প্রোটেকশনের দরকার পরলে কোন মনীষীর নামে চালিয়ে দেওয়া হচ্ছে আষাঢ়ে উক্তি, ছবি বা গোটা ভিডিও। ইদানিং ওসব ফেক নিউজ নামে পরিচিত।
ছোটবেলার মা কালীর দিব্বি এখন পুরুষোত্তম স্লোগানে বদলে গেছে। ওটাই সত্য, শিব, সুন্দর। বাকি সব দেশদ্রোহ।
এসবের মাঝে আসলে কেউ স্টকহোম সিন্ডোমে ভুগছে কিন্তু ভাবছে সে হেব্বি লিবারেল। মানে তেড়ে দেশকে খিস্তি করলে বা প্রধান ধর্মকে নিয়ে খিল্লি করলেই আপনি বিশ্বনাগরিক।
জানিয়ে রাখি স্টকহোম সিনড্রোম মানে ওই আলিয়া ভট্টর ‘হাইওয়ে’তে যেমন ছিল, সেটি এক অদ্ভুত মানসিক সমস্যা। যে নিপীড়ক তার প্রতি নিপীড়িতের অদ্ভুত এক সমবেদনা ও ভালোবাসা জন্মানো। যাকে আশেপাশের সবাই ভিলেন ভাবছে তাকে ভালোবেসে ফেলা।
দেবতা, অপদেবতা বা দেবতাসম গডম্যানেদের অশেষ কৃপায় আরেকটা শ্রেনী এই কঠিন সময়ে তৈরি হচ্ছে। যারা হাতে গরম বুঝতে পারছে কোন পক্ষ নিতে হবে। যারা বুঝতে পারছে তাদের চোখের সামনে দেশটা বদলে যাচ্ছে আর তারা চাইলে ও বদলে দিতে পারবে না এই ঘড়ি। তারা কালকে অবধি দেশকে প্রাক্তন প্রেমিকের মতো ভাবতো৷ রাগ হতো, অভিমান হতো, ঘৃণা ও ছিল বেশ। কিন্তু কী অদ্ভুত বাইরের কেউ দেশকে নিয়ে অপমানজনক বিদ্বেষপূর্ণ কথা বলতেই সে ফুঁসে উঠছে। অনেকটা ওই ছেলেবেলার মতো।
গ্রুপের সবচেয়ে ক্যালানে বন্ধুটিকে নিয়ে সারাদিন খিল্লি করবো, পেছনে লাগবো কিন্তু বাইরের কেউ ওকে কিছু অপমানজনক বললেই সবাই মিলে এক্কাট্টা হয়ে প্রতিবাদ করবো।
জানিয়ে রাখি, এই দুঃসময়ে ইমরান খানের দুই প্রাক্তন বউ শত বিরোধ থাকলেও কিন্তু ইমরান ও পাকিস্তানের পক্ষেই গলা চড়িয়েছেন। দেশের কিছু মাতব্বর খারাপ কাজ করছে বলে কি দেশটাই খারাপ নাকি? ছেলেবেলায় কয়েকটা দাদা ব্যাটিং দেবে না বলে কি অভিমানে গোটা গোল্লাছুটের মাঠটাই খারাপ বলতাম?
এই বিশাল ভূখন্ডের একশো কোটি মানুষগুলো, এর অশোকস্তম্ভ, এর সংবিধান, এর স্বাধীনতার লড়াই, এর মাটির গন্ধ, এর কোন সামান্য জমির উপর আমাদের ভিটেমাটি, তার শ্যাওলা ধরা দেওয়ালের গল্প, পাড়া থেকে চাকরি নিয়ে চলে যাওয়ার গল্প- সবকটা আমাদের দেশের গল্প। কোন শালা আমাদের থেকে ওসব কেড়ে নেবে? এদের কেউ আপনাকে বলবে না, যা পাকিস্তান বা বাংলাদেশে যা। ওটাই আসলে আমার ছেলেবেলা ও বড়বেলার মাঝে অনেকটা এগিয়ে চলা আমার জন্মভূমি। আমার দেশ।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত