সল্টলেকের জিডি মার্কেটের সামনে শিব মন্দিরের পাশে ফুটপাথের ওপর পসরা সাজিয়ে বসেছিল কয়েকজন শিশু। পসরা বলতে প্লাস্টিক কিংবা চটের টুকরোর ওপর সামান্য কিছু অপরাজিতা, টগর, পলাশ, জবা, আকন্দ ফুল, বেলপাতা, দুব্বো আর ফল বলতে ধুতরো ও বেল। বিক্রেতাদের বয়স ৬ থেকে ১০এর মধ্যে। এদের কোনদিন বাজারে দেখিনি। কথাবার্তা, হাবভাবে বোঝাই যাচ্ছে এরা শিশু শ্রমিকও নয়, নিয়মিত ফুল বিক্রেতাও নয়। যে ফুল-ফলগুলি ওরা বিক্রি করছে তা ওরা নিজেরাই ভোররাতে উঠে বিভিন্ন জায়গা থেকে তুলে এনেছে। তারপর শিবরাত্রির দিনে কিছু রোজগারের আশায় এসব সাজিয়ে বসে পড়েছে বাজারের সামনে। এই ব্যবসাবুদ্ধির তারিফ করতেই হবে। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতেই আমি দেখছিলাম, নানা বয়সের পুরুষ ও মহিলারা ওদের কাছ থেকে শিবরাত্রির জন্য প্রয়োজনীয় এসব ফুল-ফল কিনতে আসছিলেন।

খুব সামান্য দামে জিনিসগুলি বিক্রি করছিল তারা। কোনকিছুর দামই এক থেকে পাঁচ টাকার বেশি নয় কিন্তু ক্রেতারা সেটুকুও দিতে রাজি নন। অথচ দেখছিলাম শিশু ভোলানাথদের সঙ্গে একটাকা দুটাকা নিয়ে বিরাট তর্ক জুড়ে দিলেও মন্দিরে প্রণামী হিসেবে দশ থেকে পঞ্চাশ টাকা দিতে কিন্তু তাদের কোন আপত্তি নেই।� �ব্যবসায়ী� হয়ে ওঠার প্রবল চেষ্টায় এই শিশুরা তাদের জিনিসের দাম কমাতে কিছুতেই রাজি হচ্ছিল না। তা নিয়ে বাঁধছিল প্রবল তর্ক। ক্রেতাদের কেউ আসছেন গাড়িতে, কেউ সাইকেলে, কেউ রিকশয়। স্বচ্ছল নারী-পুরুষদের সামান্য টাকা নিয়ে এই তর্কাতর্কি দেখে আমার প্রথমে মজাই লাগছিল, তারপর বেশ রাগ হতে লাগলো। এই সামান্য টাকা নিয়ে ওরা এতটা তর্ক না করলেও পারতেন। কারণ, বাজারের নিয়মিত ক্রেতা হিসেবে তারা জানেন এরা ঠিক ফুলওয়ালা নয়, উৎসবের দিন কিছু আয়ের আশায় নিজেরাই একদিনের বিক্রেতা সেজেছে। একটু আগেই ওদের সঙ্গে কথা বলতে বলতে জেনেছিলাম বিক্রির টাকা দিয়ে কেউ খেতে চাইছে পটেটো চিপস, আইসক্রিম কিংবা ঝালমুড়ি। কেউ কিনতে চায় ফুটবল আবার যারা আরেকটু বেশি আয়ের আশা করছে তারা ইকোপার্কে বেড়াতে যাওয়ার কথা ভাবছে। শৈশব তো এরকমই, ঘোরতর সংসারীরা চিরকালই তা মানতে নারাজ।

আমি লক্ষ্য করছিলাম, বাজারে যে নিয়মিত ফুলওয়ালারা বসেন এই একদিনের ব্যাপারীরা তাদের চেয়ে অনেক কম দামে টাটকা ফুল দিচ্ছিল। যারা কিনছেন তারাও জানেন সেকথা। তবুও যতটা চাপ দিয়ে একটু সুবিধা আদায় করে নেওয়া যায়! এ এক বিচিত্র মানসিকতা! আমার আরেকটা জিনিস মনে হল, আমরা কিন্তু কেউই ঝাঁ চকচকে মলে ঢুকে এভাবে দরদস্তুর করার কোন সাহসই পাই না। মুখবুজে বেশি টাকা দিয়ে বহু সময় নীরেস জিনিস কিনতে বাধ্য হই। দর করার কোন পরিসরই নেই সেখানে। বাজারেও যারা দামি মাছ কিংবা ফল নিয়ে বসেন সেখানেও আমরা খুব একটা বেশি দর কষাকষি করতে পারিনা। কুলীন সেই বিক্রেতারা একটু শাঁসালো খদ্দের ছাড়া আর কাউকে পাত্তা দিতে নারাজ। একটু দর করলেই তারা অন্যদিকে তাকিয়ে পাশের খদ্দেরদের প্রতি মনোযোগ দেন। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, দর নিয়ে প্রশ্ন করার ফাঁকে পাশ থেকে আরেকজন সেটি বিক্রেতার হাঁকা দামেই কিনে নিচ্ছেন। মনে মনে অপমানিত হলেও সেখানে আমার কিছুই করার নেই। আমাদের যত হম্বিতম্বি বাজারের একপ্রান্তে, বেশিরভাগ সময়ই বাইরে যারা সামান্য শাকপাতা, গ্রামের নানা জায়গা থেকে আনা ফলমূল কিংবা চুনোমাছ সাজিয়ে বসেন তাদের ওপর। তাদের সঙ্গে বিপুল দরদাম করি আমরা, এক টাকা কম করতে পারলেও ভাবি বিরাট জিতে গেলাম!

আসলে আমরা সবসময় সবলের ভক্ত, দুর্বলের যম। সমাজতাত্ত্বিকরা বলে থাকেন এটা একটা কলোনিয়াল হ্যাং, ঔপনিবেশিক খোঁয়াড়ি। মিশ্র সম্প্রদায় অধ্যুষিত পাড়াতে দেখি, অর্থনৈতিকভাবে একটু দুর্বল পরিবারের ছেলেমেয়েরা সরস্বতী পুজো বা অন্য কোন অনুষ্ঠানের চাঁদা চাইতে এলে তাদের আমরা নমো নমো করে বিদায় করি, কখনও বা স্রেফ ভাগিয়ে দিই। কিন্তু একটু নামডাকওয়ালা পাড়ার দাদারা চাঁদা হিসেবে হাজার-দুহাজার ধার্য করে দিলেও তা দিয়ে কৃতার্থ হই! তারা পুজো দেখার পাশ দিলে তা গর্ব করে আত্মীয়স্বজনদের বলি। অন্যায়ের প্রতিবাদ করা তো দূরের কথা, চাঁদা দিতে অসুবিধা হলেও মুখফুটে তা বলতে পারিনা। পাড়া থেকে বাজার এই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়। আসলে আমাদের মানসিকতাটাই এমন! �
ভুল হতে পারে, কিন্তু এসব আমার নিজস্ব উপলব্ধি। বাজারের পাকা খদ্দেরদের সঙ্গে দরাদরিতে বিধ্বস্ত ফুল বিক্রেতা ওই শিশুদের মলিন মুখগুলি দেখে আমার এসব কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। বড় বড় ঘটনার সামনে আমরা সবাই মহৎ হয়ে যাই, চেষ্টা করি নিজেদের মহত্বকে প্রমাণ করতে। কিন্তু ছোট ছোট ঘটনাগুলি আমাদের ভিতরের আসল আমিটাকে বার করে আনে। প্রমাণ করে দেয় আমাদের নিজেদের ক্ষুদ্রত্বকে। আগে গ্রামবাংলায় নষ্টচন্দ্র বলে একটা পরব ছিল। নষ্টচাঁদের সেই রাত্রে গ্রামের ছোটরা বিভিন্ন বাগান থেকে গৃহকর্তার বিনা অনুমতিতে ফল আহরণ করে খেত। বস্তুত এটা চুরিই কিন্তু খুব বাড়াবাড়ি না হলে বড়রা এই ব্যাপারটা নিয়ে তাদের খুব একটা বকাঝকা করতো না। এই সহনশীলতাটাই যেন আজকের দিনে অদৃশ্য হয়ে গেছে। যদি আমরা ছোট ছোট ইচ্ছে, চাহিদা, স্বপ্নগুলোকে একটু মর্যাদা দিই, তাকে সাকার করে তোলার কাজে হাত লাগাতে পারি, লাগাম পরাতে পারি নিজেদের অতিরিক্ত স্বার্থবোধের ওপর তাহলে অন্তত নিজেরাই মনে মনে একটু ভালো থাকতে পারি।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত