নব্বইয়ের দশকের পর থেকে জম্মু-কাশ্মীরের সামাজিক পরিস্থিতি অনেকটাই বদল হয়ে গিয়েছে। দু’দেশের সীমান্ত সমস্যা ঘিরে একাধিক টানাপোড়েনের জেরে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়েছে। ঘরে ঘরে পড়ুয়ারা বিশেষত ছাত্ররা একটু বড় হতে না হতেই বইখাতা শিকেয় উঠিয়ে হাতে তুলে নেয় অস্ত্র। সেনাবাহিনীর উপর ভরসা না করে সদ্য কিশোর বা সদ্য যুবকরা প্রায়শয়ই লড়াইয়ের জন্য বেছে নেয় ভুল পথ। কিন্তু এবার তাদের মন দিয়ে পড়াশোনা করার পরামর্শ দিচ্ছে এক জেহাদি সংগঠন। কুখ্যাত জঙ্গি সৈয়দ সালাউদ্দিন পরিচালিত সংগঠন ‘ইউনাইটেড জেহাদ কাউন্সিলের’ তরফে কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রীদের প্রতি বার্তা দেওয়া হয়েছে, অস্ত্র থেকে দূরে থাকো, মন দিয়ে পড়াশোনা করো। কাশ্মীরের আরেক সংগঠন তেহেরিক-উল-মুজাহিদিন প্রধান তথা ইউজেসি-র সম্পাদক শেখ জামিল-উর-রেহমান বিবৃতি দিয়ে ছাত্রসমাজকে এই পরামর্শ দিয়েছেন
খুব ছোট বয়সেই ছাত্রদেরর মগজধোলাই করে ঢুকিয়ে দেওয়া হয় জেহাদি শিবিরগুলোতে। সেখানেই চলে ভারত-বিরোধী মন্ত্রপাঠ, অস্ত্র প্রশিক্ষণ। এভাবেই কাশ্মীর উপত্যকায় জেহাদি সংগঠনগুলি আরও বিস্তার লাভ করে রাষ্ট্রদ্রোহিতার আদর্শ ছড়িয়ে দিচ্ছে। কোনও কোনও ক্ষেত্রে শিক্ষিত যুবকদেরও লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায় জেহাদ। মেধাবী পড়ুয়ারা নিজেদের নিরাপদ কেরিয়ার জলাঞ্জলি দিয়ে পা বাড়ায় বিপদের পথে। সেই ভুল থেকে ছাত্রদের আটকাতেই এই বার্তা দিল ওই জঙ্গী সংগঠন।
সংগঠনের তরফে এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “ছাত্ররা আমাদের মূল্যবান সম্পদ। ঠিকমত শিক্ষা গ্রহণ না করলে, ভবিষ্যতে দেশের কোনও কাজেই তারা সফল হতে পারবে না। আমি ওদের বলতে চাই, আগে মন দিয়ে পড়াশোনা করো এবং অস্ত্রশস্ত্র থেকে দূরে থাকো। নাহলে তোমাদের অশিক্ষার সুযোগ নিয়ে যে কোনও বিপরীত শক্তিই ক্ষতি করতে পারে। শিক্ষিত তরুণরা নিজেদের বিচার, বিবেচনা,বুদ্ধি দিয়ে তবে নিজেদের রাস্তা বেছে নেবে।’ এই বিবৃতি তিনি স্থানীয় এক সংবাদ সংস্থাকে ই-মেল করেও জানিয়েছেন। তেহরিক-উল-মুজাহিদিন প্রধান অবশ্য ছাত্রদের শিক্ষাগ্রহণের প্রয়োজনীয়তার নেপথ্যে আরও একটি কারণ দেখিয়েছেন। বিবৃতিতে রেহমানের বক্তব্য, ‘পড়াশোনা ছেড়ে যদি ছাত্র সমাজ সশস্ত্র প্রশিক্ষণের পথে যায়, সেখানেও যথাযথ নিয়মশৃঙ্খলা বজায় রাখার দরকার হয়। তা না থাকলে, রাষ্ট্রীয় শক্তি তাদের সহজেই পরাজিত করবে”।
একটি সংগঠনের সমীক্ষা বলছে, কাশ্মীরের শিক্ষিত যুব সম্প্রদায়ের ভুল পথে চলে যাওয়ার ঘটনা চিরকালীন সমস্যার। কারণ, শিক্ষিত হওয়ার সত্ত্বেও নিজেদের ভাল এরা নিজেরা বুঝতে পারে না। সমাজ বদলের জন্য বিপ্লব আর রাষ্ট্রদ্রোহিতার পার্থক্য বুঝতে পারে না। সাম্প্রতিক সময়ে এতে কিছুটা বদল এসেছে। শিক্ষিত হওয়ার পর যাঁরা পরবর্তী প্রজন্মকে শিক্ষাদানের পথে হেঁটেছেন, তাঁরাও কেউ কেউ জড়িয়ে পড়ছেন জেহাদে। উদাহরণস্বরূপ ওই সমীক্ষায় তুলে আনা হয়েছে কাশ্মীরি অধ্যাপক মহম্মদ রফি ভাটের কথা। বছর দুই আগে পুলওয়ামায় সেনা অভিযানে যিনি নিহত হয়েছিলেন। তুলে ধরা হয়েছে ইউজেসি-র গুরুত্বপূর্ণ সদস্য মান্নান ওয়ানি, যে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের পিএইচডি-র কাজ ছেড়ে ‘জেহাদে’ উদ্বুদ্ধ হয়ে যোগ দেয় সংগঠনে, তার কথাও।
দিল্লির ওই সংগঠনের সমীক্ষা অনুযায়ী, একাধিক জঙ্গিশিবিরে উচ্চশিক্ষিত সদস্যের সংখ্যা নিতান্ত কম নয়। কিন্তু প্রশ্ন উঠছে, শিক্ষার আলো থাকা সত্ত্বেও কেন অন্ধকারের পথে পা বাড়ানোর প্রবণতা এদের? সমাজকর্মীদের একাংশের মত, কাশ্মীরের ছাত্রছাত্রীদের মেধাকে সর্বভারতীয় স্তরে যথেষ্ট কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। কাশ্মীরিদের সঙ্গে বাকিদের জনসংযোগের জায়গাটি অনেকটা দূর্বল এখনও। তাই নিজেদের বঞ্চিত মনে করে কাশ্মীরের শিক্ষিতরা উলটো পথে হাঁটছেন। আবার কারও মতে, জম্মু-কাশ্মীরের সামগ্রিক পরিস্থিতিও এর জন্য দায়ী। দরিদ্র পরিবারের ছেলেমেয়েরা পড়াশোনার পর যথাযথ কর্মসংস্থানের অভাবে নাম লেখাচ্ছে জঙ্গি শিবিরে, হাতে তুলে নিচ্ছে অস্ত্র। কিন্তু এবার পড়ুয়াদের প্রতি খোদ জেহাদি সংগঠনগুলোর পড়াশোনায় মন দেওয়ার আরজিতে কি আমূল পালটে যাবে পরিস্থিতি? উত্তর সময়ের অপেক্ষায়।