১৪ ফেব্রুয়ারি পুলওয়ামার জঙ্গী হামলার প্রত্যাঘাত হিসেবে বালাকোটে ভারতীয় বায়ুসেনার করা এয়ার স্ট্রাইকের পর রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেছেন ৬২ বছরের নুরান শাহ। কারণ বালাকোটে এক ডজন মিরাজ ২০০০ যুদ্ধবিমানের আচমকা হামলা এবং ১০০০ কেজির স্মার্ট বোমা ফেলে আসার পর যে সবেধন নীলমণি ‘ক্যাজুয়ালটি’র খোঁজ পাওয়া গেছে, তিনি এই নুরান। তিনি থাকেন তহশিল বালাকোট, খাইবার পাখতুনখোয়ার জাব্বা গ্রামে।
নুরান এখনও মনে করতে পারছেন না, মঙ্গলবার ভোরে বালাকোটের পাহাড়ের মাথার জঙ্গলে নিজের মাটির বাড়িতে ঠিক কী কারণে তাঁর ঘুম ভেঙে গিয়েছিল! মাটি কেঁপে ওঠায়? বিস্ফোরণের শব্দে? নাকি অন্য কোনও কারণে। তাঁর ডান চোখের ওপরে যে ছোট কাটা দাগ, তাই-ই বা কী করে হল, সেটাও মনে করতে পারছেন না তিনি। কিন্তু দেশ-বিদেশের সাংবাদিকরা এসে সেটাই বারবার জিজ্ঞেস করছে এবং বিরক্ত হয়ে উঠছেন তিনি।
তাঁর বিরক্তির আরও একটি বড় কারণ, ভারত নাকি জইশ-ই-মহম্মদ জঙ্গীদের নিকেশ করতে অতগুলো যুদ্ধবিমান পাঠিয়েছিল। আর সে কারণেই অত বোমা ফেলেছে! এ কথা শোনার পর থেকেই মেজাজ হারাচ্ছেন নুরান। উত্তরে প্রায় দাঁত খিঁচিয়ে উঠে বলছেন, ‘আমাকে দেখে কি আপনার জইশ জঙ্গী মনে হচ্ছে? নাকি এখানে আরও জঙ্গীদের দেখতে পাচ্ছেন?’ আবার রয়টার্সের সাংবাদিকের মুখোমুখি হয়ে তিনি নিজেই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলেন, ‘ওরা তো বলছে, জঙ্গী খতম করতেই বিমান হামলা হয়েছিল। তা এখানে এসে জঙ্গীদের কেমন দেখলেন?’
অন্যদিকে, রাশি রাশি জঙ্গী মারার দাবি থেকে ক্রমশ পিছু হঠছে কেন্দ্রও। কারণ এত বড় একটা বোমাবাজির পর না কোনও ধ্বংসস্তূপ দেখতে পাওয়া গেছে, আর না-ই মিলেছে কোনও মৃতদেহ। অথচ খোদ বিদেশ সচিব বিজয় গোখেল বিমান হামলার পর জানিয়েছিলেন, বহুসংখ্যক শিক্ষানবিশ জঙ্গী, তাদের প্রশিক্ষক এবং জইশ-ই-মহম্মদের ওপরের সারির কমান্ডাররা খতম! আর এক সরকারি প্রতিনিধি দাবি করেছিলেন, অন্তত ৩০০ জইশ জঙ্গীকে নিকেশ করা গেছে।
ভারতীয় বায়ুসেনার ভাইস মার্শাল আর জি কে কাপুর বলেছেন, হতাহতের হিসেব এত তাড়াতাড়ি দেওয়া যাবে না। তবে ক্ষয়ক্ষতি কতটা হয়েছে তার ‘মোটামুটি বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ’ বায়ুসেনার হাতে আছে। ওদিকে জাব্বা গ্রামের বাসিন্দারা সাংবাদিকরা মহা উৎসাহে নিয়ে গিয়ে পাহাড়ের ঢালের মাটিতে বড় বড় চারটে বোমার গর্ত দেখিয়ে দিচ্ছেন। দেখাচ্ছেন, কোন কোন পাইন গাছ বিস্ফোরণের ঝটকায় ভেঙে পড়েছে।
ছোট মালবাহী গাড়ি চালান আবদুর রশিদ। বালাকোটের পাহাড়ি রাস্তা দিয়েই রোজ তাঁর যাতায়াত। তিনি জানিয়েছেন, কিছু গাছ ভেঙেছে শুধু। কেউ মারা যায়নি, বা জখম হয়নি। তবে একটা কাক মরে পড়ে থাকতে দেখেছেন রাস্তায়। সেটা কার কেরামতি, জানা নেই।
ওসামা বিন লাদেনের সর্বশেষ ডেরা হিসেবে বিখ্যাত হয়ে যাওয়া অ্যাবোটাবাদের ৪০ কিমি দূরে পাইন গাছে ছাওয়া বালাকোট অঞ্চল পাকিস্তানি পর্যটকদের প্রিয় গন্তব্য। নিঝুম পাহাড়ি রাস্তা ধরে গেলে মনোরম কাঘান উপত্যকার আদিগন্ত বিস্তার। জঙ্গলে ঘেরা এলাকায় ৪০০ থেকে ৫০০ লোকের বাস। পাহাড়ি ঢালে ছড়িয়ে থাকা মাটির বাড়ি। ২০০৫ সালের ভূমিকম্পে তছনছ হয়ে যাওয়ার পর সব নতুন করে বানানো হয়েছে।
জনা ১৫ বাসিন্দার সঙ্গে কথা বলেছে বার্তা সংস্থা রয়টার্সের প্রতিনিধি আসিফ শাহজাদ এবং আবু আক্রম নাকাশ। এক ওই নুরান শাহর সামান্য জখম বাদ দিলে, আর কারও কোনও চোট লেগেছে বলে কেউই জানেন না। নুরান নিজেও বলেন, গত ২৬ ফেব্রুয়ারির ভোররাতে ভারতীয় বায়ুসেনার মিরাজ-২০০০ এমকে-২ স্কোয়াড্রনের ‘নন মিলিটারি প্রি-অ্যাম্পটিভ’ অপারেশনের তিনিই একমাত্র ‘শিকার’।
আবার জাব্বার সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্রের কর্মী মহম্মদ সাদিক, যিনি হামলার রাতে ডিউটিতে ছিলেন, তিনি অন্তত ৩০০ জঙ্গীর ঘায়েল হওয়ার ‘খবর’ শুনে বলেছেন, সব বাজে কথা! তাঁর কথায়, ‘গ্রামে একজনেরই চোট লেগেছিল। সেখানেই তাঁর চিকিৎসা করানো হয়।আর কেউ আহত হননি। হলে তো অন্তত কিছু জখম লোক চিকিৎসার জন্যে স্বাস্থ্যকেন্দ্রে আসত। কেউ আসেনি। বালাকোট শহরের তহশিল হাসপাতালের সিনিয়র মেডিক্যাল অফিসার জিয়া উল হকের মন্তব্য, ‘এখানে কোনও হতাহতকে নিয়ে আসা হয়নি।’
তবে বোমা যে ধারেকাছেই পড়েছে, তাতে যে সাধারণ মানুষের প্রাণহানি হতে পারত, সেটাও লোকজনের সঙ্গে কথা বলে বোঝা যাচ্ছে। জাব্বার বাসিন্দা মহম্মদ জাকির প্রথম বিস্ফোরণের আওয়াজ পেয়ে দৌড়ে ঘরের বাইরে গিয়েছিলেন। মা ডাকতে আবার ভেতরে যান। তখনই দ্বিতীয় বোমাটি পড়ে জাকিরের বাড়ি থেকে অল্প দূরে। সেখানকার মাটিতে এখন প্রায় ফুট দশেক গভীর এক গর্ত।
২৮ বছরের চৌধুরি শাফাকৎ আওয়াইস জানিয়েছেন, ২০০৫ সালের ভূমিকম্পের দুঃস্বপ্নই ফিরে এসেছিল ঘুমের মধ্যে, বিস্ফোরণের প্রাবল্যে যখন মাটি কেঁপে উঠেছিল। সকালে উঠে ব্যাপারটা বোঝার পর যে কারণে সবাই বিরক্ত। এক বাসিন্দা শওকত কুরেশি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আপনারাই খুঁজে দেখুন। এখন এখানে কোথায় জঙ্গী, কোথায় কী! যত সব ফালতু কথা।
উল্লেখ্য, খাইবার-পাখতুনখোয়া প্রদেশের মানশেরা জেলার ছোট্ট শহর বালাকোটের প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের পাহাড়-ঘেরা ওই গ্রাম ঘুরে জঙ্গী শিবিরের চিহ্নমাত্রও দেখতে পাননি বলে জানান আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা। ‘হাজার কিলোগ্রাম’ বোমায় গুঁড়িয়ে যাওয়া পাথর, জ্বলে খাক হওয়া পাইন গাছ আর খানচারেক বিশাল গর্তের পাশাপাশি তাঁরা চাক্ষুষ করেছেন নুরানের ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িটি। আর অনিবার্য ভাবেই মুখোমুখি হন গ্রামবাসীদের অমোঘ প্রশ্নের, ‘আমরাই তো এখানে আছি। আমরাই কি তবে জঙ্গী?’