পাক অধ্যুষিত কাশ্মীরের বালাকোটে ভারতের বিমান হামলার ফলে নিহত নাকি ৩০০ জঙ্গী এমনটাই দাবি দেশের শাসক দল বিজেপির। কিন্তু এই ৩০০ জইশ জঙ্গী নিকেশের দাবিকে কার্যত উড়িয়ে দিচ্ছে যুদ্ধের খবরে অত্যন্ত পারদর্শী এবং নিরপেক্ষতার জন্য বিশ্বখ্যাত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলি। এমনকি ভারতীয় মিডিয়ার যাবতীয় তথ্যাবলিকেও নস্যাৎ করে দিচ্ছে রয়টার্স, আল জাজিরা, বিবিসি-র মতো ইউরোপ, আমেরিকা এবং পশ্চিম এশিয়ার প্রথমসারির আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা।
গত মঙ্গলবার কত টনের বোমা ফেলা হল পাকিস্তানের বালাকোট শহরে? তাতে ক’জন জঙ্গী নিহত হল? কোনও প্রশ্নের উত্তরই সরাসরি সরকারি তরফে আসেনি। অনেক চ্যানেলই অসমর্থিত সূত্র উদ্ধৃত করায় দর্শক আজ বিভ্রান্ত। এমনকি একই কাজ করেছে গেরুয়া শিবিরও। তবে দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস জানাচ্ছে, সামরিক পর্যবেক্ষক এবং দু’জন পশ্চিমী নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞের মতে, বালাকোটে যেখানে ভারতীয় বিমান বোমা ফেলেছে, সেখানে সত্যিই জঙ্গী ঘাঁটি ছিল। কিন্তু ২০০৫-এ ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের পরে বিদেশি ত্রাণ সংস্থাগুলি ওই অঞ্চলে যাতায়াত শুরু করে। ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়েই জঙ্গীরা বালাকোটের এই এলাকা ছেড়ে ছোট ছোট ভাগে বিভক্ত হয়ে গোটা পাকিস্তানে ছড়িয়ে আছে। সুতরাং ভারতীয় বোমায় ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশ কম বলে তাদের ধারণা।
আবার আল জাজিরা ও বিবিসিতে এসব নিয়ে ভারতীয় প্রচারমাধ্যমকে ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। লেখা হয়েছে, ভারতীয় টিভির সঞ্চালকদের দেশপ্রেম উথলে উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। একজন ভারতীয় বিমানবাহিনীকে বার্তা দিলেন, ‘এখানে থেমো না।’ আর একজন লিখলেন, ‘ধৈর্যের শেষ, শৌর্যের শুরু।’ যেটা আশ্চর্যের, পঞ্চশীলের প্রবক্তা, ভারতের মতো শান্তিকামী দেশে যখন ‘রক্ত চাই, যুদ্ধ চাই’ রব, ঠিক তখনই তথাকথিত ‘যুদ্ধবাজ’ প্রতিবেশী দেশে বেরোচ্ছে শান্তিমিছিল। আল জাজিরার এক সাম্প্রতিক ভিডিয়োতে বিশিষ্ট তথ্যচিত্র নির্মাতা সঞ্জয় কাককে উদ্ধৃত করে বলেছে, ‘যখনই এই ধরনের কিছু হয়, তখনই কিছু ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যুদ্ধের জিগির তোলে।’
সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানাচ্ছে, ‘ভারতীয় বিমান বোমা ফেলার পরে সে দেশে উৎসব পালন করা হচ্ছে। কিন্তু এই হামলায় বিশেষ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ স্থানীয় গ্রামবাসীরা আমাদের এবং স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলিকে জানিয়েছেন, রাতে চার-পাঁচটি বোমা বিস্ফোরণের শব্দ তাঁরা শুনেছেন। তাতে কয়েকটি বাড়িতে ফাটল ধরেছে। এক জন সামান্য জখমও হয়েছেন। কিন্তু ফাঁকা মাঠে বোমাগুলি পড়ায় বড় কোনও ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।’ দ্য গার্ডিয়ান আবার এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছে যে, ভারত জুড়ে উৎসব চলছে। কিন্তু ফাইটার জেটের হানায় আদৌ গুরুত্বপূর্ণ কোনও ফল হয়েছে, না কি ১৪ ফেব্রুয়ারির পুলওয়ামায় আত্মঘাতী হামলার পর আমজনতার মধ্যে তৈরি হওয়া ক্ষোধ প্রশমনের উদ্দেশ্যই এই পদক্ষেপ, তা স্পষ্ট নয়।
ওয়াশিংটন পোস্টের দাবি, এলাকার মানুষ এবং স্থানীয় থানার পুলিশকর্মীরা আত্মপরিচয় গোপন রেখে জানিয়েছেন, বালাকোট শহরের কয়েক কিলোমিটার দূরে পাহাড়ি এলাকায় বিমান থেকে বোমা ফেলা হয়েছে। কিন্তু সেখানে বড় কোনও প্রাণহানির ঘটনা ঘটেনি। গাল্ফ নিউজও জানিয়েছে, মাদ্রাসার থেকে এক কিলোমিটার দূরে পড়ে বোমা। তবে লক্ষ্যবস্তুতে আঘাত হানতে পারেনি তারা। ভারতের দিক থেকে ছুটে আসা সামরিক অস্ত্রের কিছু অংশ পাইন গাছে আটকে গিয়েছিল। বাড়িতে এক ব্যক্তি ঘুমাচ্ছিলেন। সেই সময় তাঁর জানলার কাচ ভেঙে যায়। আবার অস্ট্রেলিয়ার এক সংস্থা স্যাটেলাইট ইমেজ প্রসেস করে দেখিয়েছে ভারতীয় বায়ুসেনার বম্বিংয়ে তেমন কিছু ক্ষতিই হয়নি জঙ্গী ঘাঁটিগুলিতে।
কয়েক বছর ধরেই, ভারতীয় চ্যানেলগুলির নিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। এবার বিদেশি চ্যানেল ও কাগজগুলিতে এ-ও বলা হয়েছে, কোনও চ্যানেলে ভারত-পাক যুদ্ধের আবহকে নাটকীয় করে তুলতে সঞ্চালক সমরসজ্জায় সজ্জিত হয়ে স্টুডিয়োতে প্রবেশ করেন। আবার কোনও চ্যানেলে সঞ্চালক ক্রিকেটের ঈশ্বরকে ‘দেশদ্রোহী’ বলে সস্তার হাততালি কুড়োন। উল্লেখ্য, দু’দশক আগে ভারতবাসীর কাছে সংবাদের মূল উৎস ছিল দূরদর্শন। তখন ছোট পর্দায় খবর মানে শুধুই সরকারের সাফল্যের খতিয়ান। আর আজ, দেশে নিউজ চ্যানেলের সংখ্যা যখন চারশো ছাড়িয়েছে, তখন ভারত-পাক সাম্প্রতিক ঝামেলার প্রেক্ষাপটে চ্যানেলের কাজ নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিল আন্তর্জাতিক প্রচার মাধ্যম।