বীর সন্তানকে ফিরিয়ে আনতে আগেই অমৃতসরে পৌঁছে গিয়েছিলেন বাবা এস বর্তমান, যিনি নিজে প্রাক্তন এয়ার মার্শাল। এবং মা শোভা বর্তমান। ওয়াঘা সীমান্তে ছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনা এবং সেনার শীর্ষ আধিকারিকরাও। এছাড়া হাতে জাতীয় পতাকা ও অভিনন্দনের ছবি নিয়ে, গালে তেরঙ্গা এঁকে ভোর পাঁচটা থেকেই অটারীতে আসতে থাকেন বহু মানুষ। আর দুপুর থেকে তো টিভি খুলেই ওয়াঘা-অটারী সীমান্তের দিকে চোখ রেখে বসে ছিল গোটা দেশ। সকলের একই প্রার্থনা, একটাই চাওয়া- এই বুঝি দেখা গেল তাঁকে।
বেলা তিনটে… সাড়ে তিনটে… চারটে… ছ’টা… আটটা… ন’টা। নানা সূত্র মারফত এক-একটা সময় জানা যাচ্ছে, আর তা পেরিয়েও যাচ্ছে। অবশেষে ধৈর্যের বাঁধ যখন ভাঙতে বসেছে, তখন সীমান্তের গেটের ও-পারে দেখা গেল তাঁকে। পাকিস্তানের সীমান্ত পেরিয়ে লাইন ওফ কন্ট্রোল ধরে এগিয়ে এসে ভারতের মাটিতে পা রাখলেন দেশের বীর উইং কমান্ডার অভিনন্দন বর্তমান।
ঘড়িতে তখন রাত ৯টা ২১। পরনে যুদ্ধবিমানের পাইলটের পোশাক নয়। ট্রাউজার্স, সাদা শার্টের ওপরে নতুন ব্লেজার চাপিয়ে ধীর পায়ে হেঁটে আসছেন ভারতের মাটির দিকে। সামনে আগ্নেয়াস্ত্র হাতে পাকিস্তানি বাহিনীর দুই জওয়ান। ডান চোখে আঘাতের চিহ্ন। কিন্তু টানটান চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই, গত বুধবার থেকেই তিনি পাকিস্তানি সেনার হাতে বন্দী। মুখের রেখা দেখেও বোঝার উপায় নেই, তাঁর যুদ্ধবিমান গুলি করে নামিয়েছিল পাকিস্তান। বিমান ভেঙে পড়ার আগে তাঁকে প্যারাসুট বেঁধে লাফ দিতে হয়েছিল। একটা মাত্র পিস্তল সম্বল করে নেমে পড়তে হয়েছিল পাকিস্তানের এলাকায়।
অভিনন্দনের পাশে তখন পাক বিদেশ মন্ত্রকের ডিরেক্টর (ভারত) ফারেহা বুগতি এবং পাকিস্তানে ভারতের এয়ার অ্যাটাশে, গ্রুপ ক্যাপ্টেন জে ডি কুরিয়েন। গেট থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়ালেন সবাই। গেট খুলে হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে এগিয়ে এলেন পাক রেঞ্জার্সের এক জওয়ান। তারপর ওই জওয়ান অভিনন্দনকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন গেটের দিকে। গেটের এ-পারে, ভারতের প্রান্তে দাঁড়িয়ে ছিলেন বিএসএফের অফিসারেরা। কমান্ডিং অফিসার হাত মেলালেন অভিনন্দনের সঙ্গে। তাঁর পাশে দাঁড়ানো আর এক অফিসার পিঠে হাত দিয়ে কাছে টেনে নিলেন পাইলটকে। স্যালুট করে ফিরলেন অটারীর দিকে। বন্ধ হয়ে গেল গেট।
অটারী চেকপোস্টের বাইরে তখন তৈরি বায়ুসেনার কনভয়। দীর্ঘ সময়ের অপেক্ষায় ঈষৎ ক্লান্ত, বৃষ্টি-ভেজা ভিড়টাও নিমেষে চাঙ্গা। বন্দুকধারী কম্যান্ডোর পাইলট নিয়ে দ্রুত বেরিয়ে গেল কয়েকটা গাড়ি। একটা ইনোভার কাচ ভেতর থেকে আড়াল করা। ‘দেশের বীর সন্তান’-কে দেখতে না পেলেও ব্যারিকেডের ঘেরাটোপে দাঁড়িয়ে মোবাইলে কনভয়ের ভিডিয়ো তুলল জনতা। উঠল হর্ষধ্বনি। কনভয় গেল অমৃতসর বিমানবন্দরে। সেখান থেকে দিল্লী পৌঁছলেন অভিনন্দন। যেখানে অপেক্ষায় ছিলেন তাঁর পরিবার। বিমানবন্দর থেকে সোজা দিল্লীর সেনা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল তাঁকে।
প্রথমে ঠিক ছিল, সূর্যাস্তের আগেই পাকিস্তান অভিনন্দনকে ভারতের হাতে তুলে দেবে। সেই দৃশ্য দেখতে পাকিস্তানের দিকে ওয়াঘা সীমান্তে অপেক্ষায় ছিল সে দেশের জনতা।
কিন্তু ক্রমশই বদলাতে থামে সময়সূচী। সরকারি সূত্রের খবর, পাকিস্তানই অভিনন্দনকে হস্তান্তরের সময় দু’বার বদল করে। প্রথমে জানানো হয়, কাগজপত্র তৈরি হয়নি। রাওয়ালপিন্ডি থেকে বিমানে লাহোর, তারপর গাড়িতে ওয়াঘার কাছে পাক সেনার একটি ব্যারাকে তাঁকে এনে রাখা হয়। প্রতিরক্ষা মন্ত্রক কর্তাদের দাবি, বরাবরের মতোই পাকিস্তান শেষ মুহূর্তে টালবাহানা করছিল। তবে কোনও দর কষাকষির চেষ্টা হয়েছিল কি না, তা নিয়ে বায়ুসেনার কর্তারা মুখ খুলতে চাননি।
ভারতের হাতে তুলে দেওয়ার ঠিক আগে অভিনন্দনের একটি ভিডিও-বিবৃতি প্রকাশ করে পাকিস্তান। মিনিট দেড়েকের ওই ভিডিওটিতে অন্তত ১৮টি ‘এডিটিং’ রয়েছে। সেখানে অভিনন্দনকে দিয়ে বলানো হয়েছে, তিনি যুদ্ধবিমানের পাইলট হিসেবে ‘টার্গেট’ খুঁজছিলেন। পাকিস্তানি বায়ুসেনা তাঁর বিমানকে নামায়। তাঁর হাতে পিস্তল ছিল। ওই বিবৃতিতে অভিনন্দনকে এ-ও বলতে শোনা গেছে, তাঁকে যে সব পাকিস্তানিরা ধরে ফেলেন তাঁদের জোশ তুঙ্গে ছিল। কিন্তু পাক জওয়ানরা তাঁকে বাঁচান। নয়াদিল্লীর মতে, অভিনন্দনকে দিয়ে জোর করে বলানো হয়েছে এসব। আর কূটনীতিকদের ধারণা, এই বিবৃতি রেকর্ড করানোর জন্যই অভিনন্দনকে ফেরাতে এত দেরি করল পাকিস্তান।
অভিনন্দনকে অভ্যর্থনা জানাতে দিল্লী থেকে ওয়াঘায় পাঠানো হয়েছিল বায়ুসেনার দুই এয়ার ভাইস মার্শাল, আর জি কে কপূর এবং এস প্রভাকরনকে। কপূর বলেন, ‘সমস্ত প্রক্রিয়া মেনে অভিনন্দনকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।’ দেশে ফিরে কী বললেন অভিনন্দন? অমৃতসর পুলিশের ডেপুটি কমিশনার এস ধীলঁ-র কথায়, ‘শুধুই হাসছিলেন অভিনন্দন। দেশে ফিরতে পেরে উনি খুশি।’