ভারত এবং পাকিস্তান দুই দেশের চরম উত্তেজনাময় পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সেনা অফিসারদের হাতে যুদ্ধবন্দী হয়েছিলেন ভারতীয় বায়ুসেনার উইং কম্যান্ডার অভিনন্দন বর্তমান। মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও তিনি ছিলেন অকুতোভয়। তথ্য আড়াল করার জন্যে কিছু জরুরী নথি তিনি খেয়ে ফেলেছিলেন, সেনা অফিসারদের এতটুকু বাড়তি প্রশ্নের উত্তর তিনি দেননি। স্পষ্ট ভাবে বলেছেন, “আই অ্যাম নট সাপোসড টু টেল ইউ দ্যাট”। এই সাহসে শিহরিত হয়েছে গোটা দেশ। এই সাহস তিনি পেয়েছেন তাঁর মায়ের থেকে। তাঁর মা-ই তাঁকে এভাবে নির্ভীক করে গড়ে তুলেছেন।
তামিলনাড়ুর বাসিন্দা অভিনন্দনের পিতৃকুলের তিন প্রজন্ম ভারতীয় বায়ুসেনায় প্রতিষ্ঠিত সেনানী। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অভিনন্দনের পিতামহ কাজ করেছেন বায়ুসেনায়। তাঁর বাবা সিমহাকুট্টি বর্তমান ছিলেন বায়ুসেনার প্রাক্তন এয়ার মার্শাল। কিন্তু অভির এই মারকাটারি সাহসের কিছুটা অবশ্যই তাঁর মায়ের অবদান। সারা বিশ্বের যুদ্ধ বিধ্বস্ত নানা দেশে ঘুরে তাঁর মা শোভা বর্তমান আর্তের সেবা করেছেন। বর্তমান পরিবারের ঘনিষ্ঠদের বাইরে খুব কম লোকই খবর রাখেন শোভার পেশাগত সাফল্য ও সাহসের। লাইবেরিয়া, ইরাক, আইভরি কোস্ট, পাপুয়া নিউ গিনি, হাইতি ও লাওসের মতো দেশে মানুষের যন্ত্রণা কমানোর কাজে সারা জীবন ব্যস্ত থেকেছেন শোভা। অভির মতো সাহসী ছেলেকে বড় করার পাশাপাশি বিশ্বের নানা দেশের যুদ্ধক্ষেত্রে মায়েদের প্রসবকালীন যন্ত্রণা কমানোর জন্য লড়াই করেছেন তিনি। মাদ্রাজ মেডিক্যাল কলেজ থেকে অ্যানাস্থেশিওলজি নিয়ে গ্র্যাজুয়েশনের পর ইংল্যান্ডের রয়্যাল কলেজ অফ সার্জনস থেকে পোস্ট গ্র্যাজুয়েশন করেন শোভা। কর্মজীবনের একটা বড় সময়ই চিকিৎসকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ডক্টর্স উইদাউট বর্ডারসের সদস্য হিসেবে সারা পৃথিবী ঘুরেছেন শোভা।
২০০৫ সালে প্রথম বার ওই সংগঠনের সদস্য হিসেবে আইভরি কোস্টে যান শোভা। একে ৪৭ ও মাস্কেটের রক্তাক্ত যুদ্ধে তাঁর কাজ ছিল আহত, যন্ত্রণার্ত মানুষের কষ্টের উপশম করা। এর পরের বছর রাষ্ট্রপুঞ্জের পক্ষ থেকে তাঁকে যেতে হয় লাইবেরিয়া। এর পর পেট্রল যুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত নাইজেরিয়ার পোর্ট হারকোর্ট শহরে যান শোভা। সেখানে তেল কোম্পানিগুলোর সঙ্গে গ্রামবাসীদের লড়াইয়ে লাশের স্তূপের পাশেই তিনি গড়ে তুলেছিলেন একটি আপৎকালীন অপারেশন থিয়েটার। দ্বিতীয় উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় ইরাকের সুলেমানিয়ায় একটুর জন্য আত্মঘাতী বিস্ফোরণে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে ফেরেন তিনি। যুদ্ধ বিক্ষত ইরানে রোগীদের সুস্থ করে তোলার পাশাপাশি প্রাণায়াম শিখিয়ে তাঁদের মনের জোরও ফিরিয়ে আনেন তিনি। যুদ্ধ বিধ্বস্ত পশ্চিম এশিয়া থেকে শোভার পরের অ্যাসাইনমেন্ট ছিল পাপুয়া নিউ গিনিতে। ২০০৯ সালে ওই দেশে রাষ্ট্রপুঞ্জের চিফ মেডিক্যাল কোঅর্ডিনেটর হিসেবে তিনি কাজ করেন মেয়েদের উপর যৌন-হিংসা ও এইচআইভি সংক্রমণের বিরুদ্ধে। আদিবাসী অধ্যুষিত পাপুয়া নিউ গিনিতে ধর্ষিতা মেয়েরা অনেক সময়ই এডসের মতো ভয়াবহ যৌনরোগে আক্রান্ত হতেন। সেই পরিস্থিতির বিরুদ্ধে সচেতনতা গড়ে তোলারও অক্লান্ত সেনানী ছিলেন শোভা।
ভিয়েতনামের পড়শি দেশ লাওসের উত্তর প্রান্তে পৌঁছনোর জন্য ১৮০০ কিলোমিটার রাস্তা গাড়িতে অক্লেশে পাড়ি দিয়েছেন প্রৌঢ়া শোভা। ভূমিকম্পে মাটিতে মিশে যাওয়া হাইতিতেও সেবার কাজে নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন তিনি। তবে এর পাশাপাশি সংসারকে কখনও অবহেলা করেননি তিনি। রাষ্ট্রপুঞ্জের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব হেলায় অগ্রাহ্য করেছেন প্যারিসে কূটনৈতিক মিশনে ব্যস্ত স্বামীর পাশে থাকার জন্য।
বায়ুসেনার অবসরপ্রাপ্ত অফিসার বাবা আর যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকায় কাজ করে যাওয়া সাহসী মা। ওঁদের ছেলে যে সুখোই-৩০ বা মিগ-২১ নিয়ে আকাশে উড়বে, রক্তে ভেসে যাওয়া মুখ নিয়েও শত্রুপক্ষের সামনে দাঁড়িয়ে নির্ভীক ভাবে কথা বলবেন এটাই তো স্বাভাবিক। এই সাহসের জোরেই তো আজ ওয়াঘা পেরোবেন অভিনন্দন।