দিল্লিতে একটি লাহোরি গেট আছে আর লাহোরে আছে একটা দিল্লি গেট৷ আশ্চর্যভাবে দুটো দ্বারেরই অভিমুখ একে অপরের দিকে। লাহোরি গেট সত্যিই লাহোরের দিকে তাকিয়ে থাকে আর দিল্লি গেট দিল্লির দিকে ফ্যালফ্যাল করে৷ সত্তর বছর ধরে।
গোটা দেশে এখন যুদ্ধ যুদ্ধ গন্ধ। পাকিস্তানের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করছে রাষ্ট্র। তা বেশ করছে। যে দুষ্টু রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদকে নিজের স্টেট পলিসি মনে করে, লাদেনদের জামাই আদর করে রাখে তাদের মতো মেরুদন্ডহীন দেশের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক না রাখাই ভালো। কিন্তু এসবের মাঝে সমান্তরাল কিছু ক্ষতি ও আছে৷
ব্যাঙ্গালোরে এক সিন্ধী পরিবার একটি খুব জনপ্রিয় বেকারি চালান। সিন্ধীরা পাকিস্তানের হিন্দু উদ্বাস্তু ছিল৷ সিন্ধ এর মানুষ। এই ‘গদ্দার’ পরিবার ছিল করাচির৷ ফেলে আসা ভিটেমাটির নামেই নাম রাখা করাচি বেকারি। আমরা যারা পাকিস্তানে ঢুকে হাফিজ সঈদ, মাসুদ আজহারকে মেরে আসতে পারিনা তারা আমাদের সুরক্ষিত চরাচরে কাশ্মীরিদের পাকিস্তানি ভেবে মারি। এক উদ্বাস্তু হিন্দু পরিবারের চালানো বেকারিতে হল্লা করে করাচি শব্দটা ঢেকে দিতে বাধ্য করি। আমাদের নিজেদের দেশে।
করাচিতে পাক সাংবাদিক বন্ধুর থেকে জানলাম এখনো সে শহরে জ্বলজ্বল করে বম্বে বেকারি, দিল্লি নিহারি, আম্বালা সুইটস, মিরাঠ কাবাব হাউস, মাদ্রাস ক্যাফের মতো দোকান৷ এখনো করাচিতে বহুল জনপ্রিয় সোনার দোকানের নাম ক্যালকাটা জুয়েলার্স। এখনো বেনারস কলোনি আছে ওখানে৷ মাদ্রাসী আর বাঙালিদের গলি আছে যেখানে ভালো মাছ পাওয়া যায় বাজারে। পাকিস্তানি মাছ বা জলের তাজা মাছ।
জানেন লাহোরের সবচেয়ে বড় হাসপাতালগুলোর মধ্যে অন্যতম হাসপাতালের নাম গঙ্গারাম হাসপাতাল। দিল্লির ও তাই। শেঠ গঙ্গারামের সমাধি ও লাহোরেই। হিন্দু মানুষটি আর ভারতে চলে আসেননি। অথচ দু দেশেই তার নিশ্বাস প্রশ্বাস রয়ে গেছে৷
এরকম বহু ভারতীয় নাম, ভারতীয় শহরের নাম, মানুষের নামের সাইনবোর্ড গোটা পাকিস্তানে ঝুলছে। জ্বলজ্বল করছে নস্টালজিয়া। দীর্ঘশ্বাস ফেলছে ক্ষয়ে যাওয়া রঙ দেশভাগের পরে। এরকমই কোন দোকানে হয়তো শফিকুল আর শ্যাম একসাথে আড্ডা দিতো। লাহোরে বা দিল্লিতে বা বম্বের কোন ইরানি ক্যাফেতে। তখন ও র্যাডক্লিফ সাহেব আমাদের হৃদপিণ্ডে দাগ টেনে দেয়নি।
কতগুলো নাম বদলালে পরে আপনার পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বদলা নেওয়া শেষ হবে? কতগুলো কাশ্মীরিকে মারলে আপনি শান্তি পাবেন? আজ করাচি বেকারির নাম বদলের অসহিষ্ণুতা দেখালেন, কাল নিশ্চই জাতীয় সংগীত থেকে ‘সিন্ধু’ শব্দটি বদলের দাবী জানাবেন। সিন্ধ প্রদেশ এখন পাকিস্তানে। যেমন হরপ্পা ও। বাদ দিয়ে দিন সিলেবাস থেকে তার ইতিহাস। আগুন লাগিয়ে দিন ইশমত চুগতাই, মান্টো, ফৈয়জ অহমদ ফৈয়জে।
ওই যে মুলতানি মাটি লাগান, ওই যে কসুরি মেথি দেন খাবার এ, ওগুলো সব কিন্তু পাকিস্তানে। মুলতান আর কসুর অঞ্চলের। আর জেনে রাখুন করাচি বেকারি আর সুইটস এখনো অন্তত এক ডজন আছে আমাদের দেশে। আমেদাবাদ, হায়দারাবাদ, দিল্লি। চিনে রাখুন। রাগ মেটাতে এগুলোতেই কালো রঙ লেপে দিতে হবে।
নজর রাখুন শিয়ালকোট, পিন্ড, বালুচী নামের হোটেলগুলোতে। ওখানে আপনার রাগ সবচেয়ে বেশি হওয়ার কথা। করাচি চিকেন, করাচি হালুয়া কোনমতেই যেন মুখে না ওঠে।
পাকিস্তানি এক বন্দিকে রাজস্থানের এক জেলে পিটিয়ে মারা আমাদের কাছে দেশত্ববোধের জয়। গদ্দারের মৃত্যুর জয়োৎসব উদযাপন করতে রাস্তায় আসুন। অনেকগুলো নখ দাঁত বের করা মুখের মাঝে কোন আধপাগল অপরিচ্ছন্ন লম্বা দাড়ি মানুষ দেখতে পেলে ওর কাছে যাবেন। নাম জিজ্ঞেস করবেন। যদি বলে টোবা টেক সিং তবে দেশের নাম জানতে চাইবেন। যদি দেশের নাম না বলতে পারে, ধরে নিতে হবে ও দেশদ্রোহী, শত্রুপক্ষ। পাকড়াও করবেন। সেনা ডাকবেন, কামান দাগবেন ওর দিকে।
এরকম এক সময়, ঠিক সূর্যোদয়ের আগে ভয়াবহ একটা আর্তনাদ করে দেখবেন সন্ত্রাসী মাটিতে মুখ থুবরে পড়ে আছে। তখন কাঁটাতারের পেছনে একদিকে একসাথে দাঁড়িয়ে ভারতের উন্মাদেরা আর আরেকদিকে কাঁটাতারের পেছনে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের উন্মাদেরা। দাঁতমুখ খিঁচিয়ে জিন্দাবাদ মুর্দাবাদ করছে। নিজের দেশের মানুষকেই পিটিয়ে মারছে। মাঝখানে একটুকরো নামহীন জমিনের উপর মুখ থুবরে পড়ে আমাদের মতো কিছু গদ্দার তোবা টেক সিং।
“উপর দি গুড়গুড় দি আনেক্সে দি বেধিয়ানা দি মুঙ্গ দি ডাল অফ দি পাকিস্তান এন্ড হিন্দুস্থান অফ দি দুর ফট্টে মুন”।
মতামত লেখকের ব্যক্তিগত