দোরগোড়ায় লোকসভা নির্বাচন। ভোটের দামামা বাজিয়ে দিয়েছে দেশের সবকটি রাজনৈতিক দলই। হন্যে হয়ে ভোট প্রচারে ব্যস্ত সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাই। আর সেই প্রচারের ঝড় উঠেছে সোশ্যাল মিডিয়াতেও। এই প্রেক্ষিতে ইনভেস্টিগেটিভ নিউজ পোর্টাল কোবরা পোস্টের সাম্প্রতিকতম প্রতিবেদনে বেআব্রু হল গোটা বলিউড। সোশ্যাল মিডিয়ায় যাঁদের অহরহ উপস্থিতি, টিভি ও সিনেমার তেমনই ৩ ডজন শিল্পী-কলাকুশলীর সঙ্গে কথোপকথনে ফাঁস হল, টাকা পেলে বিজেপির হয়ে প্রচারমূলক পোস্ট দিতে আপত্তি নেই কারও। শর্ত একটাই, টাকা দিতে হবে নগদে।
অপারেশন ক্যারাওকে। অস্তিত্বহীন একটি জনসংযোগ সংস্থার প্রতিনিধি সেজে কোবরা পোস্টের সাংবাদিকরা গিয়েছিলেন বলিউডের সেলেব্রিটিদের কাছে। লোকসভা নির্বাচনের আগে কোনও একটি রাজনৈতিক দলের হয়ে সুবিধাজনক পরিস্থিতি তৈরি করার কথা বলে কলাকুশলীদের সঙ্গে ভাব জমান তাঁরা। তাঁদের বলেন, আসন্ন লোকসভা ভোটের আগে কোনও একটি বিশেষ রাজনৈতিক দলের পক্ষে তাঁদের ফেসবুক, ট্যুইটার ও ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্ট থেকে প্রচারমূলক পোস্ট করতে হবে। বদলে মিলবে মোটা টাকা। আর তাতেই রাজি হয়ে যান বিবেক ওবেরয়, জ্যাকি শ্রফ, রাখি সাওয়ান্ত, সানি লিওন, সোনু সুদ, মহিমা চৌধুরী, আমিশা প্যাটেল, টিসকা চোপড়া, পুনম পান্ডে, গায়ক অভিজিৎ ভট্টাচার্য, কৈলাস খের, মিকা সিংহ, কোরিওগ্রাফার গণেশ আচারিয়া-সহ মোট ৩৬ জন শিল্পী। এঁদের অধিকাংশই ক্যামেরায় স্বীকার করেছেন যে, টাকা পেলে বিজেপির জন্য ইতিবাচক পোস্ট করতে তাঁরা অবশ্যই রাজি।
সানি লিওন থেকে শুরু করে পুনম পাণ্ডে। সোশ্যাল মিডিয়ায় দুজনেরই ফলোয়ারের সংখ্যা অসংখ্য। তাঁরা কিছু শেয়ার করলে মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। এরা যদি কোনও রাজনৈতিক দলের হয়ে প্রচার করেন, তাহলে অন্যান্য দলের রাজনৈতিক দলের তুলনায় সেই দলের জনপ্রিয়তা যে বাড়বে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। টাকার বিনিময়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় বিজেপির পক্ষে ভাল ভাল পোস্ট করার প্রস্তাবে রাজি পুনম পান্ডে জানান, মোটা টাকা পেলে তিনি নিশ্চয়ই তা করবেন। প্রাক্তন পর্নস্টার সানি লিওন আবার ৫ কোটি টাকা পারিশ্রমিক ছাড়া আরও একটি আবদার করেছেন। তাঁর স্বামী ড্যানিয়েল ওয়েবারের জন্য ভারতের বিদেশি নাগরিকের মর্যাদা চেয়েছেন। বলেছেন, ‘মোদি স্যার যদি ড্যানিয়েলকে ওভারসিজ সিটিজেন করে দেন, তা হলে অবশ্যই সমর্থন করব।’ প্রসঙ্গত, ফেসবুক এবং টুইটারে ৪ কোটি করে ফলোয়ার সানির। ইনস্টাগ্রামে ১৯ কোটি।
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর বায়োপিকে তাঁর ভূমিকায় দেখা যাবে বিবেক ওবেরয়কে। সোশ্যাল মিডিয়ায় তাঁকে বিজেপির প্রচারে এতই উদগ্রীব দেখা গেছে, যে তৎক্ষণাৎ চুক্তিবদ্ধ হতে চেয়েছেন। এমনকি পাশে বসা তাঁর ম্যানেজারকে চুক্তি সেরে ফেলার নির্দেশও দিয়েছেন। গত বছর গোপন ক্যামেরায় তোলা ওই তদন্তমূলক প্রতিবেদনে প্রথমে ২০ কোটি টাকা দাবি করেন অভিনেতা সোনু সুদ। পরে মাসিক আড়াই কোটি টাকা দাবি করেন। প্রতিবেদককে বলেন, ‘বুঝতেই পারছেন, আমি বিষয়টি খুব গুরুত্ব দিয়ে দেখব। প্রতিদিন ৫-৭টি টুইট/পোস্ট লিখব। সেগুলো খুব জোরালো, ক্ষুরধার হবে। যদি একদিনে ৫টির বদলে ৪টি টুইট করি, সেক্ষেত্রে অন্য কারোর টুইট তুলে নিজের একটা বয়ান জুড়ে দেব। তবে তার জন্য মাসে আপনাদের বলা দর দেড় কোটিতে হবে না। আড়াই কোটি লাগবে।’
গায়ক অভিজিৎ আবার প্রচারবার্তায় স্বতঃস্ফূর্ত দেখাতে মোবাইলে ভিডিও তোলার পরামর্শ দিয়ছেন। বলেছেন, ‘মোবাইল ক্যামেরায় ভিডিও তুললে বিষয়টি স্বাভাবিক মনে হবে। ধরুন যদি ট্র্যাফিক সিগন্যালে, গাড়িতে বসে, অথবা রাস্তার ধারে বা কফি শপে কিছু বলি, তা হলে সেটা ভনিতাহীন মনে হবে।’ গোপন ক্যামেরার সামনে সম্প্রদায়–বিশেষের বিরুদ্ধে বিষোদ্গারও করেছেন বিতর্কিত গায়ক। এক বিজেপি বিধায়কের মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছেন, ‘রাজা সিং ঠিকই বলেছেন। উনি হায়দ্রাবাদের যোগী আদিত্যনাথ। বলেছেন, রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার কী দরকার? ওদের গুলি করে মারছে না কেন? ঠিকই বলেছেন। আমাদের মনোভাব এরকমই হওয়া উচিত।’
অন্যদিকে, মহিমা চৌধুরীকে একটি পোস্টের জন্য এক কোটি টাকা চাইতে শোনা যাচ্ছে। ‘বিজেপি যত ইচ্ছে দিতে পারে… ওরা মাসে এক কোটি করেও দিতে পারে।‘ এভাবেই প্রতিটি পোস্টের জন্য কলাকুশলীরা গড়ে ২ থেকে ৫০ লক্ষ টাকা পর্যন্ত দাবি করেছেন। কেউ কেউ তো ৮ মাস ধরে টানা পোস্টের জন্য এক লটে ২০ কোটি টাকা অবধি চেয়েছেন। জ্যাকি শ্রফের মতো কয়েকজন তো বাড়তি হিসেবে ইউটিউবেও প্রচার চালানোর কথাও বলেন। কিন্তু তাৎপর্যপূর্ণভাবে কেউই কালো টাকা গ্রহণে সামান্য আপত্তি পর্যন্ত করেননি বলে প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে। এমনকি কোবরা পোস্টের সাংবাদিকরা যখন পিআর এক্সিকিউটিভ সেজে তাঁদের সঙ্গে পারিশ্রমিকের একটি অংশ হোয়াইট মানি বা সাদা টাকায় দেওয়ার কথা বলছিলেন, তখন তাঁরা প্রায় সকলেই তাতে অসন্তোষ প্রকাশ করেন। কোবরা পোস্টের সাংবাদিকদের এটাই বিস্মিত করেছে যে, ওই ৩৬ জনের অনেকেই অবলীলায় প্রচারের পারিশ্রমিক কালো টাকায় নিতে আগ্রহ দেখিয়েছেন।
তবে ব্যতিক্রমও আছে। কোবরা পোস্টের প্রতিবেদনেই প্রকাশ যে বিদ্যা বালান, রাজা মুরাদ, আরশাদ ওয়ারসি, সৌম্যা ট্যান্ডনের মত অভিনেতারা সরাসরি প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছেন। বিদ্যা বালান কিংবা আরশাদ ওয়ারসির সেক্রেটারিরা সরাসরি প্রস্তাব খারিজ করে দিয়েছেন। অন্যদিকে রাজা মুরাদ জানিয়েছেন তাঁর কোনও ট্যুইটার অ্যাকাউন্টই নেই। নতুন অ্যাকাউন্ট খুলে দেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তা পত্রপাঠ প্রত্যাখ্যান করে দেন বলে জানিয়েছে কোবরা পোস্টের ওই প্রতিবেদন।