‘আপনা টাইম আয়েগা’ — জীবনের পথে চলতে গিয়ে যতবারই মুখ থুবড়ে পড়ে, ততবারই নিজের হারানো আত্মবিশ্বাস ফিরে পেতে এই মন্ত্র জপে মানুষ। হ্যাঁ, আমরা প্রত্যেকেই কোনও না কোনও সময়ে নিজেকে এই কথা বলে উদ্দীপ্ত করেছি যে, ‘আমারও সময় আসবে’। ঠিক তেমনটাই করেছে ‘গালি বয়’ ছবির মূল চরিত্র মুরাদ। মুম্বইয়ের ধারাভি বস্তির সরু গলি থেকে উঠে আসা এক র্যাপারের গল্প হল ‘গালি বয়’। বাস্তবের র্যাপার ডিভাইন এবং নাইজি-র জীবন থেকে হালকাভাবে তুলে আনা এই ছবির গল্প।
মুরাদ (রণবীর) মুম্বইয়ের ধারাভি বস্তির বাসিন্দা এবং কলেজ পড়ুয়া। কিন্তু কবিতা আর ছন্দ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। বাবা (বিজয় রাজ) পেশায় ড্রাইভার, মুরাদের চেয়ে বয়সে কিঞ্চিৎ বড় এক মহিলাকে দ্বিতীয় স্ত্রী করে বাড়িতে আনে। হতদরিদ্র সংসারে বাবা তাকে খাওয়ার খোঁটা দেয়, পড়ার খোঁটা দেয়, চাকরি করে পয়সা আনার জন্য জোর করে, গায়ে হাত তোলে। এমন দমবন্ধ করা পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়ে সর্বক্ষণই মুরাদের মনে এ প্রশ্ন জাগে, ‘কিঁউ ইয়ে লগতা হ্যায় ইয়ে বস্তি এক অন্ধা কুয়াঁ হ্যায়?’
তবে প্রতিকূল পরিস্থিতিতে বাঁচতে-বাঁচতে মুরাদ স্বপ্ন দেখে সে একদিন র্যাপার হবে। কলেজে পড়তে পড়তেই লোক চক্ষুর আড়ালে সে খাতায় কবিতা লেখে। একদিন সাক্ষাৎও হয়ে যায় সত্যিকারের এক র্যাপ গায়ক শের (সিদ্ধান্ত)-এর সঙ্গে। শের তাকে শেখায় র্যাপ হল এক ধরনের কবিতা। শের জানায় মুরাদের ভিতর সেই কবিতা রয়েছে, কিন্তু রয়েছে ছন্দের অভাব। এর পরে রাতের পর রাত জেগে সেল ফোনে রেকর্ড করে মুরাদ সেই কবিতা। লক্ষ্য রাখে কবিতার শরীরে ছন্দ আসছে কিনা। বাবার চাপে সে এক কোটিপতি ব্যবসায়ীর বাড়িতে ড্রাইভারের চাকরি নিলেও গাড়ির চাকার ঘূর্ণির সঙ্গেই এগোতে থাকে তার র্যাপ-জার্নি।
অন্যদিকে, মুরাদের প্রেমিকা সাফিনা (আলিয়া) আবার ভারী ডানপিটে মেয়ে। একইসঙ্গে প্রেমিকের প্রতি ভয়ঙ্কর পজেসিভও। অন্য কোনও মেয়ে মুরাদের সঙ্গে ‘গুলুগুলু’ করলেই সে হাত-পা চালিয়ে দিতে কসুর করে না। তাঁর সাফ কথা, ‘মেরি বয়ফ্রেন্ডসে গুলুগুলু কারেগি তো ধোপতুঙ্গি না উসকো।’ কিন্তু এর পাশাপাশি মুরাদের সঙ্গীতের প্রতি প্রেমকে সে আমলও দেয়। তাঁকে সাহায্যও করে বিভিন্ন ভাবে।
ছবির গল্প যত এগোতে থাকে, ততই মুরাদের কবিতার মধ্যে এসে পড়ে তার চারপাশের জগৎ। বস্তির ছোট ঘরে বসবাসের যন্ত্রণা, মায়ের প্রতি বাবার অবহেলা। তাঁর কলম হুবহু লিখে ফেলে বস্তির শোষিত মানুষের চোখ মুখের অভিব্যক্তি। আবার সে গর্জে ওঠে বস্তির ছোটদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার করাতেও বা তাঁর মায়ের গায়ে বাবার হাত তোলাতেও। এই সব কিছুই প্রতিফলিত হয় ওর কবিতায়।
মুরাদের র্যাপার হওয়ার স্বপ্ন আদৌ সার্থক হবে কিনা, আদৌ সে শ্রেষ্ঠ র্যাপার হতে পারবে কিনা, এই নিয়ে ছবির গল্প এবং টেনশন। যেহেতু মুরাদ সমাজের একদম নীচুতলা থেকে উঠে আসছে সাফল্যের শীর্ষে, তাই তাঁর এই লার্জার দ্যান লাইফ জার্নি পর্দায় দেখাতে জোয়া আখতার একটু বেশি সময় নিয়েছেন। এই কারণে ছবির চলন একটু ধীর গতির। কিন্তু সেই ঢিমে তালে চলাটা ছবির কোনও ক্ষতি না করে ভালই করেছে।
‘জীবনে যদি কমফর্ট থাকবে, তাহলে র্যাপ তৈরি হবে কেন?’ এমনই সংলাপ শোনা যায় এই ছবির এক চরিত্রের গলায়। কিন্তু সেই কবিতা হতে হবে ছন্দে। সেই চরিত্রটি র্যাপকে সংজ্ঞায়িত করেন ‘পোয়েট্রি উইথ রিদম’। জানা যায়, নিউ ইয়র্ক শহরের বস্তি থেকে উঠে এসেছে মূলত অ্যাফ্রো-আমেরিকান কৃষ্ণাঙ্গদের সঙ্গীত র্যাপ। শ্রমজীবী মানুষের গানই হল র্যাপ। জ্যাজ সঙ্গীতের মতো এর ভাষাও প্রতিবাদের ভাষা। দূর্নীতি থেকে শুরু করে রাজনীতি, শিক্ষা ব্যবস্থা, রেসিজম, হিংসা এবং সমস্ত রকমের শোষণের বিরুদ্ধে মুক্তির কবিতা হল র্যাপ।
‘গালি বয়’ ছবির বিষয়বস্তু যেহেতু র্যাপ মিউজিক এবং হিপ-হপ কালচার, তাই ছবিতে গান এবং কবিতার উপস্থিতি তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে পরিচালককে সহায়তা করেছেন মুম্বইয়ের প্রথম শ্রেণির সমস্ত র্যাপাররা। আর মুরাদের কবিতা লিখেছেন স্বয়ং জাভেদ আখতার। অন্যদিকে, পরিচালক জোয়া আখতারের সঙ্গে এ ছবির কাহিনি-চিত্রনাট্য লিখেছেন আরেক পরিচালক রিমা কাগতি। গোটা ছবিতেই যে কোনও পরিস্থিতিতে মুরাদের ভিতরকার প্যাশন তাকে দিয়ে তৈরি করিয়ে নেয় শব্দ-সুর-কল্প। সেই পরিস্থিতিগুলোকে ভারী সুন্দর করে চিত্রনাট্যে বুনেছেন জোয়া-রিমা।
মুরাদের ভূমিকায় রণবীর সিং যে-মাপের অভিনয় করেছেন, তা বলিউড মেনস্ট্রিম ছবিতে খুব একটা দেখা যায় না। তিনি ছাড়া এই চরিত্রটি আর কেউ করতে পারতেন কিনা সন্দেহ রয়েছে। রুপোলি পর্দার একটি চরিত্র আগাগোড়া কাল্পনিক হয়েও রণবীরের লার্জার দ্যান লাইফ অভিনয়ের গুণে তা হয়ে ওঠে ঠিক যেন পাশের জলজ্যান্ত মানুষটি। আর শুধু অভিনয়ই নয়, এই ছবির জন্য একজন প্রফেশনাল র্যাপারের মতোই দক্ষতার সঙ্গে র্যাপ গেয়েছেন তিনি।
আবার এ ছবি যতটা রণবীরের, ততটা আলিয়ারও। পজেসিভ প্রেমিকা, যে প্রেমিকের জন্য অন্য মেয়ের মাথায় কাচের বোতলও ভাঙতে পারে— এমন চরিত্রকে যেভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন আলিয়া, তা তারিফ করার মতোই। রণবীরের সঙ্গে আলিয়ার প্রেমের সমীকরণেও কোনও ফাঁকফোকর নেই। এতটাই সাবলীল তাঁরা। চমকে দিয়েছেন সিদ্ধান্ত চতুর্বেদীও। রণবীরের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেছেন তিনি। আবার বিজয় রাজও বদমেজাজি বাবার চরিত্রে যথাযথ।
বরং মার্কিন দেশ থেকে উড়ে আসা সঙ্গীতের ছাত্রী স্কাই (কল্কি কোয়েচলিন)-এর চরিত্রটি বড়ই দুর্বল করে তৈরি করা হয়েছে। তবে নিজের অভিনয় দক্ষতা দিয়ে সে’টুকু খামতিও পূরণ করে দিয়েছেন কল্কি। ভাল লাগে জয় ওঝার সিনেম্যাটোগ্রাফি। নিতীন বৈদ-এর এডিট-ও এ ছবিকে মেদবর্জিত করতে সাহায্য করেছে। এক আন্ডারডগের ভিতর চাপা বারুদের মতো যে প্যাশন থাকে, উৎসাহের সামান্য ফুলকি লাগলে হতাশার অন্ধকারেও তা তুবড়ির মতো জ্বলে ওঠে, এই আখ্যানটিই বড় সহজে বুনেছেন পরিচালক জোয়া।
পর্দায় বাস্তব জীবনের গল্প বলতে গিয়ে একমুহূর্তের জন্যেও অবাস্তব মনে হয়নি এ ছবি। সেখানেই এ ছবির জোর। বড্ড জ্যান্ত মনে হয় এ ছবির প্রেম, এ ছবির লড়াইকে। অ্যান্টনি ফিরিঙ্গী ছবিতে যেমন কবির লড়াইতে প্রতিটা কবিগান ধেয়ে আসার পর তার পাল্টা দিতে দেখা গেছিল অ্যান্টনিকে, তেমনি ‘গালি বয়’-এও র্যাপ-ফাইটের সময় যতবার আঘাত ধেয়ে আসে মুরাদের দিকে, ততবারই তা নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে, নিজের কথা দিয়ে, ‘শব্দব্রহ্ম’ দিয়ে ফিরিয়ে দেয় সে। যাতে পিছু হটে যায় শত্রুপক্ষ। পিছু হটে যায় যা কিছু অশুভ। তাই মুরাদের ‘মুরাদ’ পূরণের সঙ্গে সঙ্গেই এ ছবি শোনায় জীবনের জয়গান।